প্রকাশিত :  ০৬:৩৫
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

চায়ের কাপে লুকানো ঝুঁকি: টি-ব্যাগে ভারী ধাতুর চিত্র

চায়ের কাপে লুকানো ঝুঁকি: টি-ব্যাগে ভারী ধাতুর চিত্র

সংগ্রাম দত্ত: প্রাতঃকালে এক কাপ চা — বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ জীবনের অপরিহার্য অংশ। কোটি কোটি মানুষের রুটিন, আড্ডা ও আরাম-ক্ষণকে নির্দিষ্ট করে এই চা; কিন্তু এসডোর (Environment & Social Development Organization)-এর সাম্প্রতিক গবেষণা দেখে প্রশ্ন জাগে — সেই প্রতিদিনের ঘোঁটায় কী আছে?

লিড: স্বাদে না, রিপোর্টে বিষণ্ণতা

এসডোরের ‘ব্রিউইং টক্সিনস: এক্সপোসিং দ্যা হেভি মেটাল হ্যাজার্ড ইন টি-বাগস অ্যান্ড ড্রাইড লুজ টি’ শিরোনামের গবেষণায় স্থানীয় বাজার থেকে সংগৃহীত ১৩ নমুনা (১২ টি-ব্যাগ ও ১টি চা পাতা) পরীক্ষা করে উদ্বেগজনক ফল পাওয়া গেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে—টি-ব্যাগ ও তার প্যাকেজিংয়ে বিপজ্জনক মাত্রায় ভারী ধাতু ধারণ করা হচ্ছে, যা নিয়মিত চা-পানের ফলে লোকালু স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াতে পারে।

কী পাওয়া গেল — সংক্ষিপ্ত ফলাফল

নমুনা: ১৩টি (১২ টি-ব্যাগ + ১টি ড্রাইড লুজ টি)

প্যাকেজিং/টি-ব্যাগে শনাক্ত ভারী ধাতু (সর্বোচ্চ পরিমাপ):

ক্রোমিয়াম: ১,৬৯০ পিপিএম (নিরাপদ সীমা: ৫ পিপিএম)

সীসা: ৫১ পিপিএম (নিরাপদ সীমা: ৫ পিপিএম)

পারদ: ১০৮ পিপিএম (নিরাপদ সীমা: ০.৩ পিপিএম)

আর্সেনিক: ১৪ পিপিএম (নিরাপদ সীমা: ২ পিপিএম)

চা পাতা আলাদা করে পরীক্ষায় অ্যান্টিমনি পাওয়া গেছে (সর্বোচ্চ ১৫৪ পিপিএম)। এছাড়াও ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের নগণ্য নির্ণয় করা হয়েছে।

একই পরীক্ষায় চা পাতায় কিছু পুষ্টি উপাদানও মিলেছে — আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, কপার, জিঙ্ক, কোবাল্ট ইত্যাদি।

মানুষের অভ্যাস — জরিপের মর্ম

রিপোর্টে ৩,৫৭১ জনের মতামতও সংগ্রহ করা হয়েছে। ফলাফল ইঙ্গিত করেছে:

৫৫% মানুষ প্রতিদিন ২–৩ কাপ চা পান করেন।

২৭% মানুষ প্রতিদিন ৪ বা তারও বেশি কাপ পান করেন।

কিন্তু শুধুমাত্র ১% মানুষ ধারণা রাখতেন যে টি-ব্যাগে ভারী ধাতু থাকতে পারে।

এই মিলিয়ে দেখা গেলে—উচ্চ মাত্রার ভারী ধাতু যদি নিয়মিতভাবে কাপে চলে আসে, তাহলে দৈনন্দিন ব্যবহারের ফলে ক্ষেত্রে জনগণের ন্যূনতম সচেতনতাও নেই।

কর্তৃপক্ষ ও বিশেষজ্ঞদের প্রতিক্রিয়া

এসডোর-এর প্রেস ব্রিফিংয়ে সংস্থার চেয়ারম্যান সৈয়দ মার্গুব মোরশেদ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “এটি ভোক্তা অধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন। আমরা অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানাই।”

বাংলাদেশ চা বোর্ডের গবেষণা কর্মকর্তা মো. নাজমুল আলম বলেন, এই গবেষণা উদ্বেগজনক; ভবিষ্যতে সরকারি অংশীদারদের সঙ্গে সমন্বয় করে অংশগ্রহণমূলক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। বিএসটিআই-এর সহকারী পরিচালক ইসমাত জাহান গবেষণাকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, দ্রুত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে — তবু দেশীয় চা শিল্পকে টিকিয়ে রাখা এবং বিকাশে কাজ করা জরুরি।

কি প্রশ্ন উঠে — কারণ ও প্রভাব

অতিদূষিত প্যাকেজিং উপাদান কি মূল সমস্যা, নাকি উৎপাদন-প্রক্রিয়া বা পরিবেশগত দূষণ? রিপোর্টে উভয় সম্ভাবনার ইঙ্গিত আছে; কিন্তু ব্যাপক, স্বাধীন তৃতীয় পক্ষের পরীক্ষার প্রয়োজন।

নিয়মিত ও উচ্চ মাত্রায় ভিজা/খাবারের সঙ্গে যুক্ত ভারী ধাতু দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যে ক্ষতি করতে পারে — তাই জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি একেবারেই নাকচ করা যাবে না।

পরবর্তী করণীয় (সংক্ষিপ্ত)

নির্ভরযোগ্য, তৃতীয়-পক্ষ ল্যাব দ্বারা ব্যাপক নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা।

প্যাকেজিং উপকরণ ও প্রস্তুত প্রক্রিয়া পুনঃমূল্যায়ন; প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রক মান নির্ধারণ ও প্রয়োগ।

ব্র্যান্ড ও উৎপাদকদের টেস্ট রিপোর্ট উন্মুক্ত করার দাবি; ভোক্তা-সচেতনতা বাড়ানো।

দীর্ঘমেয়াদি জনস্বাস্থ্য মূল্যায়ন ও প্রয়োজন হলে নির্দেশিকা-প্রস্তুতি।

রাঙ্গানো শেষ কথা

এক কাপ চা — সহজ, তাত্ক্ষণিক আরাম। কিন্তু যদি সেই আরামের সঙ্গে লুকিয়ে থাকে স্বাস্থ্যঝুঁকি, তখন বিষয়টি আর ব্যক্তিগত আচরণ বা রুটিনের মধ্যে সামলানো যাবে না। এসডোরের রিপোর্টটি কেবল সংখ্যার এক তালিকা নয়; এটি একটি আড়ম্বরিত সতর্কবাণী — ভোক্তা অধিকার, মান নিয়ন্ত্রণ এবং স্বচ্ছতাই এখন প্রধান আলোচ্যবিষয় হওয়া দরকার।



Leave Your Comments




জীবনশৈলী এর আরও খবর