প্রকাশিত :  ০৫:৪০
২২ ডিসেম্বর ২০২১

শিক্ষার মান অবনমনে মধ্যম আয়ের দেশের উপযোগী মানবসম্পদ তৈরি বাধাগ্রস্ত হবে

শিক্ষার মান অবনমনে মধ্যম আয়ের দেশের উপযোগী মানবসম্পদ তৈরি বাধাগ্রস্ত হবে


অবকাঠামো, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্বল আর্থসামাজিক অবস্থা, দুর্নীতি, জটিল কর সিস্টেম, সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব প্রভৃতি সমস্যা বাদেও আজ বাংলাদেশের বড় সমস্যা সঠিক ও দক্ষ জনবল খুঁজে পাওয়া এবং তাদের উৎপাদনশীলভাবে কাজে লাগানো। প্রাথমিক শিক্ষা সম্প্রসারণে এবং লিঙ্গবৈষম্য হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও পাঠ্যক্রম মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্য পূরণে ততটা লাগসই ভূমিকা রাখতে সমর্থ হচ্ছে না। সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্প খাতের মধ্যে যোগাযোগ ও সহযোগিতার অভাব রয়েছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আধুনিক শিল্পের জন্য মানসম্পন্ন ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির ক্ষেত্রে। অভাব পূরণের জন্য, পোশাক, টেক্সটাইল, বায়িং হাউজ, টেলিযোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি শিল্প চালানোর জন্য প্রতিবেশী দেশ থেকে প্রচুরসংখ্যক বিদেশী পেশাদার ও প্রযুক্তিবিদ আনতে হয়েছে এবং হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রতি বছর কয়েক বিলিয়ন ডলারের অধিক অর্থ দেশ থেকে চলে যাচ্ছে।

দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি জাতীয় উন্নয়নের চাবিকাঠি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে নিত্যনতুন আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের ফলে উন্নয়ন কৌশল ও পদ্ধতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য আমাদের শিক্ষার্থীদের অবশ্যই কারিগরি ও বৃত্তিমূলক পেশার মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে হবে এবং বিদ্যালয়ের পঠিত বিষয় হিসেবে একে বাধ্যতামূলক করতে হবে; গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকল্পে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যুক্তিসংগত অনুপাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশাল শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকের সম্মুখে শতাধিক শিক্ষার্থীর উপস্থিতি শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে কী গভীর সমস্যার সৃষ্টি করে, তা সহজেই অনুমেয়। এজন্য পরীক্ষার ফলাফলের ক্ষেত্রে ঘটে অনিবার্য বিপর্যয়। তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত একটি যুক্তিযুক্ত সীমার মধ্যে রাখতে হবে। প্রতি বছর বিদেশী ঋণের কোটি কোটি টাকা খরচ করে যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, তা কতটুকু মানসম্পন্ন ও লব্ধ প্রশিক্ষণ বিদ্যালয় বা মহাবিদ্যালয় পর্যায়ে কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে, তা নিবিড়ভাবে মনিটর করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে বিদ্যালয় পর্যায়ে প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান, দৃষ্টিভঙ্গি ও দক্ষতা প্রয়োগে সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করে উত্তরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

উন্নয়ন কার্যক্রম পুরোদমে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে এশিয়ার বিস্ময় দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া কাম্য জনসংখ্যা নির্ধারণ ও অর্জন নিশ্চিত করেছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি শিল্পায়নের উপযোগী মানবসম্পদ, অর্থাৎ শিক্ষিত কর্মশক্তি গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় শিক্ষা সংস্কারে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করে। এতে শিক্ষার হার (১৫+ বয়সীদের প্রায় শতভাগ শিক্ষার হার  অর্জন করেছে) যেমন  দ্রুত বৃদ্ধি পায়, পাশাপাশি দ্রুততার সঙ্গে দক্ষ জনশক্তি তৈরির মাধ্যমে সেসব দেশ কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতেও সক্ষম হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৯৪৫ সালে শিক্ষার হার ছিল ২২ শতাংশ। ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে বৈজ্ঞানিক, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেয়া হয়। ব্যাপক বাধা সত্ত্বেও সরকার দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে দক্ষ জনবল সরবরাহ নিশ্চিতে দৃঢ়ভাবে তা বাস্তবায়ন করে। ফলে উন্নয়নের অনেক লক্ষ্য দ্রুত অর্জন হতে থাকে। দর্শনীয় শিল্পায়ন আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চমকে কোরিয়ার জনগণ দ্রুতই আধুনিক শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে এবং সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসে। ফল হলো, অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সাধারণ ঐতিহ্যবাহী শিক্ষার জায়গায় বৈজ্ঞানিক, কারিগরি ও কর্মক্ষেত্রের উপযোগী বিশেষায়িত জ্ঞানসমৃদ্ধ শিক্ষা স্থান করে নেয়। অবাক করা বিষয়, দুই দশক আগের পশ্চাত্পদ দরিদ্র ও চরমভাবে কুসংস্কারাচ্ছন্ন কোরীয় সমাজে ১৯৮০-এর দশকে এসে বৈজ্ঞানিক শিক্ষা, পেশা ও বিজ্ঞানীরা সমাজ ও রাষ্ট্রে সবচেয়ে সম্মানিত বিবেচিত হয়ে ওঠে। দেশটির বর্তমান মাথাপিছু আয় ৩১ হাজার মার্কিন ডলার এবং উন্নয়নের ধারায় অনেক আগেই উন্নত দেশের কাতারে স্থান করে নিয়েছে।

সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে প্রযুক্তির গুরুত্বের কথা বলা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেসব প্রযুক্তি বাস্তবায়নের জন্য যে মানবসম্পদের প্রয়োজন তা কীভাবে তৈরি করা যায়, সেদিকে তেমন নজর দেয়া হচ্ছে কি? সম্প্রতি বাংলাদেশের উন্নয়ন গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে—তৈরি পোশাক, আইসিটি, নির্মাণ, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, পর্যটন, হালকা প্রকৌশল, স্বাস্থ্যসেবা, জাহাজ নির্মাণ আর ওষুধ তৈরি—প্রায় সাত কোটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ জনশক্তি ও ব্যবস্থাপকের প্রয়োজন হবে। তাহলে পাস করে শুধু সনদপ্রাপ্ত হলেই চলবে না, হতে হবে শিক্ষাপ্রাপ্ত। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে অবস্থিত ন্যাশনাল স্কিলস ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে কাউন্সিলকে ঢেলে সাজানো ও গতিশীল করা প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিংয়ের ১০০-এর মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই জায়গা করে নিতে পারছে না। র্যাংকিং নিয়ে বিজ্ঞজনদের নানান মত। কেউ বলেন, এর পেছনে ছোটার প্রয়োজন নেই। কেউ বলেন, এটা প্রাসঙ্গিক নয়। র্যাংকিংয়ের পেছনে ছোটার প্রয়োজন নেই, তবে র্যাংকিংয়ের মানদণ্ড মাথায় রেখে পূরণের চেষ্টা করলে তো ক্ষতি নেই। সেক্ষেত্রে এমনিতেই র্যাংকিং ধাপে ধাপে উপরে উঠবে। সেদিকে কর্তৃপক্ষ মনোযোগী নয়। শিক্ষাদানের মান ও পরিবেশ, গবেষণার প্রকাশিত সংখ্যা ও সুনাম এবং সাইটেশন বা গবেষণার উদ্ধৃতি—এ তিনটি মানদণ্ডের দিকে নজর দিলেই যথেষ্ট।

লাগসই মানবসম্পদ সৃষ্টির মাধ্যমে একদিকে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ, অন্যদিকে বিদেশে বিনিয়োগ সম্ভব। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে বাংলাদেশের প্রধান দুটি অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির একটি ‘রেমিট্যান্স’, মানে বাংলাদেশী প্রবাসীদের উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠানো, যার প্রধান উৎস মধ্যপ্রাচ্য। আজ মধ্যপ্রাচ্যে প্রযুক্তির বাস্তবায়নে সেখানকার উৎপাদন ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে ধীরে ধীরে মানবসম্পদ চাহিদার পরিবর্তন ঘটছে, যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানবসম্পদ তৈরির ক্ষেত্রে মনোনিবেশ করা বাঞ্ছনীয়, যদি রেমিট্যান্সের পরিমাণ ধরে রাখতে কিংবা তা বাড়াতে চাই।

গণিতকে বলা হয় বিজ্ঞানের জননী। শুধু তাই নয়, গণিত দর্শনেরও জননী।  আড়াই হাজার বছর আগে প্লেটোর স্কুলে বিজ্ঞান অধ্যয়নের ভালো ব্যবস্থা ছিল; সেখানে গণিতের চর্চাকেও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হতো। প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাঁচ হাজার বছর আগে গণিতের চর্চায় বেশ অগ্রগতি হয়েছিল। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে ভারতবর্ষের কথা উল্লেখ করা যায়। বিজ্ঞানের গবেষণা বর্তমানে এমন উচ্চপর্যায়ে চলে গেছে যে মানুষের মস্তিষ্ক ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যৌথভাবে কাজ করে কোনো সমস্যা থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়া খুঁজে বের করে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সম্পর্কিত বিভিন্ন আলোচনা এখন উচ্চশিক্ষার স্তরেই সীমিত রয়েছে। এ প্রবণতা হয়তো আরো কিছুদিন চলমান থাকবে। বাংলাদেশ যদি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল বেশিমাত্রায় পেতে চায়, তাহলে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই এ-সম্পর্কিত জ্ঞানের প্রাসঙ্গিক আলোচনা শুরু করতে হবে। এ-সম্পর্কিত জ্ঞানের আলোচনার অন্যতম প্রধান বার্তাটি হলো, জ্ঞানচর্চায় কোনো বিভাজন থাকা অনুচিত। জ্ঞানের সমন্বিত চর্চা ছাড়া চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল পাওয়ার কথা চিন্তা করা যায় না।

গুণগত শিক্ষা কোনো একটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে অর্জনের আশা করা যায় না। এজন্য প্রয়োজন অনেক উপাদানের সমন্বিত এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনা ও কর্মকাণ্ড। গুণগত শিক্ষার জন্য যেসব উপাদানের যথাযথ সমন্বয় সাধন করতে হয়, সেগুলো হচ্ছে আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম, পর্যাপ্তসংখ্যক যোগ্য ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক, প্রয়োজনীয় শিক্ষাদান সামগ্রী ও ভৌত অবকাঠামো, যথার্থ শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি, উপযুক্ত মূল্যায়ন পদ্ধতি, ধারাবাহিক পরিবীক্ষণ ইত্যাদি। শিক্ষার সব স্তরে গুণগত মান অর্জনের লক্ষ্যে নিম্নবর্ণিত সুপারিশগুলোর আলোকে আসন্ন বাজেট ও পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং নীতি নির্ধারণ করা জরুরি। দেশে শিক্ষা খাতে প্রকৃত অর্থায়ন পর্যাপ্ত নয় এবং প্রকৃত বরাদ্দ মোট জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ। এ হার আমাদের প্রতিবেশী দেশের তুলনায় অপ্রতুল। বিভিন্ন গবেষণায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রাপ্ত মোট বৈদেশিক সহায়তার ২৫ শতাংশ অর্থ শিক্ষা খাতে ব্যয় করার জন্য যে সুপারিশ করা হয়েছে, বাংলাদেশকে তা মেনে চলতে হবে। এ-সংক্রান্ত সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে শিক্ষার গুণগত ও পরিমাণগত দিক সুষম ও সুসংহত হবে।


Leave Your Comments




মত-বিশ্লেষণ এর আরও খবর