প্রকাশিত : ০৯:৪৮
০২ জুলাই ২০২২
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিএইচআরএফ) অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং (জিন নকশা উন্মোচন) হয়। এখন যুক্তরাজ্যে আছেন সেঁজুতি। সেখান থেকে করোনাভাইরাসের নতুন উপধরন ও এর গতিপ্রকৃতি নিয়ে তাঁর গবেষণার বিষয়ে কথা বলেছেন।
জুন মাসে দেশে করোনা শনাক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে জেনোম সিকোয়েন্সিং করেছে সিএইচআরএফ। সংক্রমিত মানুষের মধ্যে অমিক্রনের উপধরন বিএ৫–এর প্রাধান্য কতটা?
সেঁজুতি সাহা: সিএইচআরএফ সেই ২০২০ সাল থেকে কোভিডের এই ভেরিয়েন্টগুলোর (ধরন) ওপর নজরদারি রাখছে। প্রতি মাসে আমরা যখন কোনো সার্স-কোভ ২ কেস পাই, তখনই চেষ্টা করি কী কী ধরন আছে, তা বাংলাদেশে ছড়াচ্ছে। আমরা দেখলাম, গত জুন মাসে নতুন ঢেউ শুরু হলো। আর আমরা সিকোয়েন্সিং করে দেখলাম, যে কেসগুলো সিকোয়েন্স করেছি, এর সবই অমিক্রন এবং ৮০ শতাংশই বিএ ৫। তাই বলা যায়, বিএ৫–ই এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রাধান্যশীল উপধরন। তবে আমাদের এই নজরদারি চালিয়ে যেতে হবে এবং দেখতে হবে, এ উপধরনের মধ্যে আরও মিউটেশন আসছে কি না বা নতুন কোনো উপধরন ছড়াচ্ছে কি না।
করোনার সর্বশেষ ঢেউ থেকে বর্তমান ঢেউয়ের ব্যবধান মাত্র তিন মাস। আমাদের টিকাকরণ বেশ সন্তোষজনক। তারপরও দুটি ঢেউয়ের মধ্যে ব্যবধান এত কম হলো কেন বলে আপনার মনে হয়?
সেঁজুতি সাহা: আমরা তিন মাস ব্যবধান দেখেছি। এর আগের ঢেউগুলোর মধ্যে ব্যবধান কিন্তু আরও কম ছিল। সর্বশেষ তিন মাস যে আমরা কাটালাম, সে সময় রোগীর সংখ্যা অনেক কম ছিল। গত দুই বছরের কথা চিন্তা করলে এটা বলতে হয়। আমার মনে হয় না, এর মধ্যে ব্যতিক্রমধর্মী কিছু আছে। বরং আমরা দেখছি, ঢেউগুলোর মধ্যে ব্যবধান দিন দিন বাড়ছে। হ্যাঁ, টিকাকরণ অবশ্যই সন্তোষজনক। বাংলাদেশে বেশির ভাগ মানুষ দুটি ডোজ পেয়ে গেছেন। অনেকে আবার তৃতীয় ডোজও পেয়েছেন। আমরা জানতে পারছি, এখন যে টিকার কার্যকারিতা, তা কিন্তু আস্তে আস্তে কমে যায়। এটা হতে পারে যে আমরা যারা অনেক আগে দুটি ডোজ নিয়ে ফেলেছি, কিন্তু বুস্টার নিইনি, তাদের মধ্যে ইমিউনিটি কিছুটা কমেছে। আর সে জন্যই হয়তো এই ঢেউ এ সময়ে দেখতে পাচ্ছি। তবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না, কেন এখন এই ঢেউ এসেছে। আমরা সারা বিশ্বে দেখতে পাচ্ছি, সার্স কোভ-২–তে মিউটেশন হচ্ছে এবং তা হবেই। মিউটেশন হয়ে হয়ে নতুন নতুন ধরন ও উপধরন দেখছি। আর এসব ধরন বা উপধরন ছড়াচ্ছে। যখন একটি ধরন বা উপধরন বেশি ছড়ায়, তখন আমরা একটি করে ঢেউ দেখতে পাচ্ছি। আমার মনে হয়, আমরা এমন ঢেউ কিছুদিন পরপর দেখতে থাকব আরও কিছুদিন।
বিএ৫–এর বৈশিষ্ট্য কেমন? অন্য ধরনের সঙ্গে এর ভিন্নতা বা মিল আছে? আপনি এর আগে আমাকে বলেছেন, এ উপধরন আমাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকে ফাঁকি দিতে পারে। কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি সম্ভব?
সেঁজুতি সাহা: আমরা জানি, এটি অমিক্রনের উপধরন। তাই অমিক্রনে প্রথম যাঁরা আক্রান্ত হয়েছিলেন, তার সঙ্গে এর মিল আছে। অমিক্রনের সব মিউটেশন বিএ৫–এ থাকবে। অমিক্রনের দুটি উপধরন বিএ৪ ও বিএ৫। দুটিই বেশ কাছাকাছি। আমরা বাংলাদেশে দেখতে পাচ্ছি, অন্তত আমাদের পর্যবেক্ষণে যে বিএ৫টিই এখানে প্রাধান্যশীল। বিএ৪ ও বিএ৫—এ দুটি মিউটেশন আছে চোখে পড়ার মতো। এর মধ্যে একটি হলো এল৪৫২ আর। এই মিউটেশন কিন্তু আমরা ডেলটা ধরনেও দেখেছিলাম। আমরা ধারণা করেছিলাম, এ মিউটেশনের কারণেই এই উপধরন দ্রুতগতিতে ছড়াতে পারে। আরও বেশি ছোঁয়াচে হয়ে যেতে পারে। কারণ, এই মিউটেশন ভাইরাসটাকে মানবকোষের সঙ্গে যুক্ত হতে বেশি সহায়তা করে। বিএ৪ ও ৫–এ আরেকটি মিউটেশন আছে। সেটি হলো এফ ৪৮৬। এই মিউটেশন হচ্ছে যেখানে স্পাইক প্রোটিন মানবকোষের সঙ্গে যুক্ত হয়, ওটার কাছাকাছি। ধারণা করা হচ্ছে, এই মিউটেশন ভাইরাসটাকে সহায়তা করে আমাদের ইমিউনিটিকে ধোঁকা দিতে বা ফাঁকি দিতে। আমরা এটা জানি, বিএ৪ বা ৫ অন্য ধরনগুলোর চেয়ে বেশি হারে ছড়ায়। কিন্তু আমরা এটা জানি না, এটা অন্য ধরনগুলোর চেয়ে বেশি গুরুতর নয়, কম রোগ সৃষ্টি করে। বিএ৪ ও ৫—দুটিই কিন্তু শনাক্ত হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। এসব এসেছিল জানুয়ারিতে। আমরা দেখেছি, ঢেউ এসেছে, আবার চলেও গেছে সেখানে। তবে দক্ষিণ আফ্রিকায় অত বেশি ক্ষতি করতে পারেনি, যতটা প্রথমবার অমিক্রন ধরন করেছিল। এর পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে। এর একটি কারণ হতে পারে অবশ্যই টিকা। আবার ওই দেশে অমিক্রন ধরন দিয়ে যেহেতু বড় ঢেউ হয়েছিল, তাই ওটার কারণেও মানুষের মধ্যে একটি প্রতিরোধক্ষমতা ছিল। বিএ৫ কিন্তু শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের নানা দেশে দ্রুতগতিতে ছড়াচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে গত কয়েক সপ্তাহে বিএ৪ ও ৫ দ্রুত ছড়াচ্ছে।
এটি যদি রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকে ফাঁকি দেওয়ার মতো শক্তি রাখে, সে ক্ষেত্রে টিকার ভূমিকা কী হতে পারে?
সেঁজুতি সাহা: টিকার ভূমিকা কিন্তু এখনো অনেক অনেক বড়। টিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মধ্যে এই উপধরনের মাধ্যমে সংক্রমণ বেড়ে গেলেও মৃত্যুর হার কিন্তু সে হারে বাড়তে পারেনি। আমাদের হাসপাতাল যাওয়ার সংখ্যা কম। দক্ষিণ আফ্রিকায় আমরা দেখেছি মৃত্যু ও হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংখ্যা অনেক কম। তাই নিশ্চয়ই টিকার কোনো একটা ভূমিকা আছে। আমাদের যদি টিকা থাকে, তবে আক্রান্ত হলেও এর তীব্রতা কম হবে। আমরা ভালোভাবে লড়াই করতে পারব রোগটাকে। তাই কথা হলো, আমাদের দুটি ডোজ নিতে হবে। আর পারলে বুস্টার ডোজও নিতে হবে। কিছু কোম্পানি কিন্তু এখন শুধু অমিক্রনের জন্য একটি টিকা আনার চেষ্টা করছে। তবে সেই টিকা আসতে আসতে অমিক্রন থাকবে, না অন্য কোনো ধরন চলে আসবে, তা বলা কঠিন। তাই এখন আমাদের হাতে যে টিকা আছে, তা নিয়ে নিতে হবে। ডোজ শেষ করতে হবে এবং বুস্টার নিতে হবে।
মাস্ক পরার ক্ষেত্রে সরকার আবার কড়াকড়ি আরোপ করেছে। এ নিয়ে আপনার পরামর্শ কী থাকবে?
সেঁজুতি সাহা: অসম্ভব গরম। মাস্ক পরা খুবই কষ্ট। আমার নিজেরও কষ্ট হয়। তবে মাস্ক পরতেই হবে, এর গুরুত্ব অনেক। কারণ আমরা জানি, করোনার ধরন যেটাই হোক, মাস্ক তাকে আটকাবেই। যে কদিন এই ঢেউ আছে, আমাদের খুব কড়াকড়িভাবে মাস্ক পরা উচিত। যাঁরা বৃদ্ধ আছেন, ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে যাঁরা আছেন বা যাঁদের কোমর্বিডিটি আছে, তাঁদের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। যারা তরুণ, তাদের নিশ্চিত করতে হবে, অন্য রোগগুলো অবহেলা করব না। আমাদের করোনার পরীক্ষার সংখ্যা কমে গেছে। টেস্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এটা না করলে করোনার গতিপ্রকৃতি ঠিকমতো বোঝা যাবে না। আমাদের নীতিনির্ধারকেরা ঠিকমতো ব্যবস্থা নিতে পারবেন না।