প্রকাশিত : ০৮:২৬
১৩ অক্টোবর ২০২৫
বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন সময় খুব কমই এসেছে, যখন রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজ একসাথে একই মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান শুধু একটি সরকারের পতন ঘটায়নি, বরং একটি যুগের সমাপ্তি ঘটিয়েছে। এর ফলেই দেশ আজ এক নতুন সন্ধিক্ষণে—যেখানে একইসাথে চলছে সংস্কারের অপরিহার্যতা, স্থিতিশীলতার পরীক্ষা এবং গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্মাণের প্রক্রিয়া।
এই ঐতিহাসিক মোড়ের কেন্দ্রবিন্দুতে এখন সমগ্র জাতির মনোযোগ নিবদ্ধ তিনটি প্রশ্নে—
১️. ২০২৬ সালের নির্বাচন কবে এবং কেমন হবে?
২️. সেনাবাহিনী এই প্রক্রিয়ায় কী ভূমিকা রাখছে?
৩️. রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্য কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে?
১. নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তার অবসান, কিন্তু নতুন পরীক্ষার সূচনা
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসকে জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। এটি কেবল একটি তারিখ ঘোষণা নয়—বরং এক রাজনৈতিক কৌশল। একদিকে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ ছিল দ্রুত নির্বাচনের জন্য, অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে সংস্কারের দাবি। এই ঘোষণার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার দুই দিকের চাপই সামঞ্জস্য করার চেষ্টা করেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে—সময় পাওয়া গেলেও সেই সময় কতটা কাজে লাগানো যাবে?
বিএনপি এখনো বলছে, “নির্বাচন আগে, সংস্কার পরে”; অন্যদিকে এনসিপি ও জামায়াতসহ সংস্কারপন্থীরা বলছে, “সংস্কার ছাড়া নির্বাচন মানেই পুনরাবৃত্তি।”
ড. ইউনূসের ফেব্রুয়ারির সময়সীমা মূলত এই দুই বিপরীত ধারাকে এক সেতুবন্ধে আনতে চায়—যেন একটি গ্রহণযোগ্য ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন আয়োজন সম্ভব হয়।
কিন্তু বাস্তবতা কঠিন। প্রশাসনিক প্রস্তুতি যত দ্রুত এগোচ্ছে, রাজনৈতিক ঐকমত্য ততই দূরে সরে যাচ্ছে। আর সেটিই এখন সবচেয়ে বড় ঝুঁকি।
২. সংস্কারের রাজনীতি বনাম নির্বাচনের রাজনীতি
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে “ক্ষমতায় কে থাকবে”—এই প্রশ্নই মুখ্য ছিল। কিন্তু এখন প্রশ্নটি বদলে গেছে—“কীভাবে ক্ষমতায় আসবে?”
ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার এজেন্ডা এই প্রশ্নের নতুন উত্তর দিতে চায়।
সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে যেমন রয়েছে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল—তেমনি রয়েছে বিচার বিভাগ ও পুলিশ সংস্কারের মতো গভীর প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের প্রস্তাব।
এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র এক নতুন কাঠামো পাবে, যেখানে ক্ষমতার ভারসাম্য ও জবাবদিহিতা—উভয়ই নিশ্চিত হতে পারে।
তবে রাজনৈতিক বাস্তবতা জটিল। বিএনপি বলছে, একটি অনির্বাচিত সরকার এত বড় সাংবিধানিক পরিবর্তন করার ম্যান্ডেট রাখে না। অন্যদিকে এনসিপি ও নাগরিক সমাজ বলছে, সংস্কার ছাড়া নির্বাচন মানে পুরনো ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি।
অর্থাৎ—সংস্কার বনাম নির্বাচনের দ্বন্দ্ব আসলে ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের ভিত্তি নিয়েই এক নীরব লড়াই।
৩. সেনাবাহিনী: অতীতের ছায়া থেকে সহযোগিতার নতুন ভূমিকা
বাংলাদেশের ইতিহাসে সেনাবাহিনী সাধারণত “শেষ ভরসা” বা “শেষ ভীতি”—এই দুই ভূমিকাতেই পরিচিত। কিন্তু ২০২৪-পরবর্তী সময়ে এই বাহিনী এক নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে।
যখন শেখ হাসিনার সরকার প্রতিবাদকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়, তখন সেনাবাহিনী সেই নির্দেশ অমান্য করে। সেই সিদ্ধান্তই রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনের পথ খুলে দেয়।
বর্তমানে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান একাধিকবার বলেছেন, সেনাবাহিনী গণতান্ত্রিক উত্তরণে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে, কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতায় অংশ নেবে না।
এই অবস্থান দেশের ইতিহাসে এক ইতিবাচক মোড়।
তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন—অতিরিক্ত প্রশাসনিক বা অবকাঠামোগত দায়িত্বে সেনাবাহিনীর দীর্ঘমেয়াদি সম্পৃক্ততা যেন বেসামরিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল না করে।
কারণ, গণতন্ত্র তখনই টেকে, যখন সেনাবাহিনী শক্তিশালী, কিন্তু অরাজনৈতিক থাকে।
৪. রাজনৈতিক মেরুকরণ: পুরনো দ্বিদলীয়তার অবসান, নতুন সমীকরণের উদ্ভব
আওয়ামী লীগের ওপর আইনি নিষেধাজ্ঞা কার্যত দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রকে বদলে দিয়েছে। তিন দশকের দ্বিদলীয় রাজনীতির অবসান ঘটেছে। এখন সামনে তিনটি শক্তি—
১️. বিএনপি — নির্বাচনে দ্রুত অংশ নিতে চায়,
২️. এনসিপি — সংস্কারপন্থী ছাত্র-নেতৃত্বাধীন নতুন শক্তি,
৩️. জামায়াত — সংস্কারের সুযোগে পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে।
এই ত্রিমুখী বাস্তবতা ২০২৬ সালের নির্বাচনকে করে তুলবে এক নতুন রাজনৈতিক পরীক্ষাগার।
কোনো দল এখন এককভাবে এগিয়ে নেই। বরং যে দল বা জোট সংস্কার ও গণতন্ত্রের মিশ্রণকে গ্রহণযোগ্য রূপ দিতে পারবে, জনম্যান্ডেট শেষ পর্যন্ত তার পক্ষেই যাবে।
৫. অর্থনীতি: রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সরাসরি বলি
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এখন বাংলাদেশের রাজনীতির নীরব মাপকাঠি। প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৩.৩ শতাংশে, ব্যাংকিং খাত দুর্বল, আর বিনিয়োগকারীদের আস্থা নড়বড়ে।
আইএমএফের চতুর্থ কিস্তি স্থগিত হওয়া শুধু অর্থনীতির নয়, সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক আস্থারও সংকেত।
এখানে রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক স্পষ্ট—
যতদিন রাজনৈতিক ঐকমত্য ও স্থিতিশীলতা না আসবে, ততদিন অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে না।
ড. ইউনূসের সাম্প্রতিক জাপান সফর এবং অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি নিয়ে আলোচনাগুলো আন্তর্জাতিক আস্থা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা, যা আংশিক হলেও ইতিবাচক দিকনির্দেশ করছে।
৬. ভবিষ্যতের পথে: সংস্কার, স্থিতিশীলতা ও বৈধতার ত্রিভুজ
বাংলাদেশ এখন এক ‘ট্রানজিশনাল রিপাবলিক’—যেখানে সবকিছুই পুনর্গঠনের পথে।
২০২৬ সালের নির্বাচন কেবল সরকার গঠনের নয়, রাষ্ট্র গঠনের নির্বাচন হবে।
এই নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করবে—
সংস্কারগুলো কতটা কার্যকর হলো,
সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকা টিকে রইল কি না,
এবং রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের পারস্পরিক আস্থার জায়গায় ফিরতে পারল কি না।
যদি অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ছয় মাসে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখাতে পারে, তবে বাংলাদেশ একটি নতুন গণতান্ত্রিক দিগন্তে প্রবেশ করবে।
কিন্তু যদি সংস্কার বিলম্বিত হয় বা নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তবে ২০২৬ হয়তো আরেকটি রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দেবে—যার প্রভাব অর্থনীতি ও সমাজ উভয়কেই নাড়া দেবে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এখন আর কোনো একক দলের হাতে নয়—বরং তিনটি শক্তির ত্রিভুজে: সংস্কার, স্থিতিশীলতা ও বৈধতা।
যে নেতৃত্ব এই তিনটিকে ভারসাম্যে রাখতে পারবে, সেই নেতৃত্বই ইতিহাসে টিকে থাকবে।
অন্যথায়, ২০২৬ সালের নির্বাচন হয়তো ক্যালেন্ডারে কেবল একটি তারিখ হয়ে থাকবে—কিন্তু হারিয়ে যাবে গণতন্ত্রের স্বপ্ন।