প্রকাশিত : ১৩:২৮
০৩ অক্টোবর ২০২৫
✍️ রেজুয়ান আহম্মেদ
গাজা উপত্যকা এখন কেবল একটি ভৌগোলিক স্থান নয়, এটি মানব ইতিহাসের এক দীর্ঘ, মর্মন্তুদ উপাখ্যান। অক্টোবর ২০২৫-এ এসে এই ভূখণ্ডটি দুই বছর ধরে চলা সামরিক সংঘাতের চূড়ান্ত বিপর্যয় বয়ে চলেছে। ৭ অক্টোবর ২০২৩-এর হামাস-নেতৃত্বাধীন আক্রমণের জবাবে ইসরায়েল যে নিবিড় সামরিক অভিযান শুরু করেছিল, তার লক্ষ্য ছিল হামাসের সামরিক সক্ষমতা ধ্বংস করা এবং ২৫১ জন জিম্মিকে উদ্ধার করা। কিন্তু এই দুই বছরের অবিরাম যুদ্ধ গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে, যার মাত্রা সামরিক লক্ষ্যের চেয়েও বেশি কিছুকে ইঙ্গিত করে। এখানে মানবিক সংকট, অবকাঠামোর সম্পূর্ণ বিলুপ্তি এবং শিশুদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক আঘাত এতটাই গভীর যে তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বয়ে চলবে।
১. ধ্বংসের প্রবেশপথ: অক্টোবর ২০২৫-এর রাজনৈতিক পটভূমি
সামরিক সংঘাতের দুটি বছর এবং আগ্রাসনের তীব্রতা:
৭ অক্টোবর ২০২৩-এর আক্রমণে প্রায় ১২০০ ইসরায়েলি নিহত হওয়ার পর, ইসরায়েলি সামরিক অভিযান প্রায় বিরতিহীনভাবে চলেছে। সংঘাতের এই দীর্ঘায়ন গাজার জনজীবনকে সম্পূর্ণভাবে ভেঙে দিয়েছে। ২০২৫ সালের শুরুতে, জানুয়ারি মাসে হামাস এবং ইসরায়েলের মধ্যে একটি পরিকল্পিত দ্বিপাক্ষিক যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও, মার্চ মাসের ১৮ তারিখ ইসরায়েলের ব্যাপক বিমান হামলার পর তা চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়ে।
এরপর সংঘাত নতুন মোড় নেয় মে ১৬, ২০২৫-এ, যখন ইসরায়েল 'Operation Gideon's Chariots' শুরু করে। এই অভিযান গাজায় সামরিক আক্রমণকে আরও মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে তোলে, যার মূল লক্ষ্য ছিল হামাসকে পরাজিত করে অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্তির জন্য চাপ সৃষ্টি করা। এই সামরিক উচ্চতার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৫-এ, যখন ইসরায়েলি নিরাপত্তা মন্ত্রিসভার অনুমোদনে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী গাজা সিটির নিয়ন্ত্রণ নিতে স্থল হামলা শুরু করে। ধারণা করা হয়, প্রায় ৪৮ জন জিম্মি এখনো গাজায় বন্দি রয়েছেন, যার মধ্যে প্রায় ২০ জন জীবিত থাকতে পারেন।
আন্তর্জাতিক অচলাবস্থা এবং কূটনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা:
এই ভয়াবহ সংকটের মুখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কার্যত বিভক্ত ও নিষ্ক্রিয়। গাজায় 'অবিলম্বে, শর্তহীন ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতির' দাবিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আনা একটি প্রস্তাবকে যুক্তরাষ্ট্র আবারও ভেটো দিয়েছে। এই কূটনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা স্পষ্ট করে তোলে যে মানবিক সংকটের গভীরতা সত্ত্বেও, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে অক্ষম।
অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পক্ষ থেকে একটি ২০-দফা শান্তি পরিকল্পনা উত্থাপন করা হয়েছে, যা ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জিম্মিদের মুক্তি এবং হামাসকে ভবিষ্যৎ শাসনে কোনো ভূমিকা থেকে বাদ দেওয়ার উপর জোর দেয়। তবে হামাস এর আগে মার্চ ২০২৫ থেকে একাধিক যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি চুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। ইসরায়েলের নিরাপত্তা অগ্রাধিকার এবং হামাসের অনীহা—এই দুই কারণে সমাধানের পথ রুদ্ধ হয়ে আছে।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ইসরায়েলের ঘোষিত লক্ষ্য (হামাসকে ধ্বংস ও জিম্মি মুক্তি) এবং তাদের সামরিক কৌশলের মধ্যে একটি অসামঞ্জস্য রয়েছে। যদি লক্ষ্য কেবল হামাস ধ্বংস হয়, তাহলে প্রায় ৯২ শতাংশ বাড়িঘর ধ্বংস করা, ৯৭ শতাংশ স্কুলকে ক্ষতিগ্রস্ত করা এবং মানবিক সহায়তা ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলা অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। এই বিপুল ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা সামরিক লক্ষ্যের চেয়েও বেশি কিছুকে ইঙ্গিত করে—তা হলো গাজাকে জনবসতি এবং জীবনধারণের জন্য অযোগ্য করে তোলা। এর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী সামরিক দখল বা জনসংখ্যা স্থানান্তরের পথ প্রশস্ত হতে পারে, যা ফিলিস্তিনিদের ভবিষ্যতের জন্য এক মারাত্মক চ্যালেঞ্জ।
অন্যদিকে, নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো এবং কার্যকর আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের অনুপস্থিতি কেবল রাজনৈতিক অচলাবস্থা নয়, বরং আন্তর্জাতিক মানবিক আইন (IHL) প্রয়োগের বৈশ্বিক কাঠামোর গুরুতর দুর্বলতা নির্দেশ করে। যখন একটি পক্ষ চলমান মানবিক সংকটে ত্রাণ প্রবেশাধিকার বা স্থায়ী যুদ্ধবিরতির দাবিকে বারবার ভেটো দেয়, তখন তা সংঘাতের দীর্ঘায়নকে উৎসাহিত করে এবং দেখিয়ে দেয় যে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধাপরাধ রোধ করতে কার্যত অক্ষম।
২. সংখ্যার আড়ালে কান্না: নিহত ও আহতদের মর্মন্তুদ হিসাব
নিহত ও আহতদের ভয়াবহ পরিসংখ্যান:
গাজায় সংঘাতের কারণে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় সবচেয়ে প্রকটভাবে ফুটে ওঠে নিহত ও আহতদের মর্মান্তিক পরিসংখ্যানে। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ নাগাদ গাজায় সরাসরি সংঘাত-সম্পর্কিত কারণে নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ৬৬,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত এই সংখ্যা কমপক্ষে ৬৫,৪১৯ জন এবং আহত হয়েছেন ১,৬৭,১৬০ জনেরও বেশি মানুষ।
সংঘাতে শিশুদের ওপর যে অসম এবং জঘন্য প্রভাব পড়েছে, তা ইউনিসেফের রিপোর্টে পরিষ্কার। সংস্থাটি জানিয়েছে, নিহত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ১৭,০০০-এরও বেশি শিশু। এই বিশাল সংখ্যক শিশুর মৃত্যু যুদ্ধের বর্বরতা এবং বেসামরিক জনগোষ্ঠীর উপর আক্রমণের তীব্রতা তুলে ধরে।
একটি বিশ্লেষণ অনুসারে, ২০২৫ সালের ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার পর থেকে সংঘর্ষের তীব্রতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। জুলাই ২৩, ২০২৫ পর্যন্ত মাত্র ছয় মাসে প্রায় ৮,৩৬৩ জন নিহত এবং ৩১,০৪৪ জন আহত হয়েছেন। এই পরিসংখ্যান ইঙ্গিত করে যে গাজা সিটিতে স্থল আক্রমণের প্রস্তুতি বা কার্যকর হওয়ার সাথে সাথে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো এবং জনবহুল এলাকায় আক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বেসামরিক মৃত্যুর হার তীব্রভাবে বেড়েছে।
মানবিক কর্মীদের বলিদান এবং খাদ্যপ্রার্থীদের হত্যা
গাজার চরম বিপজ্জনক পরিস্থিতি মানবিক কর্মীদের বলিদানে প্রতিফলিত হয়। এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত গাজায় ৫৪৩ জন মানবিক কর্মী নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করা হয়েছে। এই সংখ্যাটি ত্রাণ সরবরাহের প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে জড়িত জীবনের ঝুঁকিকে তুলে ধরে।
আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, খাদ্য ও সাহায্যের সন্ধানে থাকা বেসামরিকদের উপর হামলা। ২৭ মে ২০২৫-এ ইসরায়েলি সামরিক নিয়ন্ত্রিত খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা চালুর পর ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খাদ্য সহায়তা প্রত্যাশী কমপক্ষে ২,৩৪০ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর (OHCHR) উল্লেখ করেছে যে এই ধরনের হত্যা জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসার প্রাপ্যতাকে মারাত্মকভাবে সীমিত করছে। ত্রাণ বিতরণে বাধা এবং ত্রাণ নিতে আসা মানুষের ওপর আক্রমণ—এই দুটি বিষয় ইঙ্গিত দেয় যে শুধুমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, বরং বেঁচে থাকার মৌলিক প্রক্রিয়াগুলিও চরম ঝুঁকির মুখে। এটি জনসংখ্যাকে চরম বিপদে ফেলা এবং তাদের জীবনধারণের সকল উপায় নস্যাৎ করে দেওয়ার শামিল।
৩. গাজা: বিধ্বস্ত বাড়ি, নিশ্চিহ্ন জনপদ
অবকাঠামোর সামগ্রিক ধ্বংসলীলা:
প্রায় দুই বছরের এই সংঘাত গাজার জনপদকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার অনেক পরেও গাজার মানুষ নিরাপদে তাদের বাড়িতে ফিরতে পারবে কিনা, তা নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। গাজার প্রায় ৯২ শতাংশের বেশি আবাসন ইউনিট এবং মোট কাঠামোর প্রায় ৭০ শতাংশ হয় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে বা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্প্রতি ২০২৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের বিশ্লেষণ অনুসারে, উত্তর গাজা এবং রাফাহতে ধ্বংসের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সম্প্রতি শুরু হওয়া গাজা সিটি আক্রমণের ধারাবাহিকতায় ঘটেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অবকাঠামোর ৭০ শতাংশের এই ব্যাপক ধ্বংস, বিশেষত আবাসন ও স্কুলের উপর আঘাত, কেবল যুদ্ধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নয়। এটি গাজার সামাজিক ও নাগরিক জীবনের ইচ্ছাকৃত বিলুপ্তি, যা ‘উর্বিসাইড’ (শহর হত্যা) হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। আবাসন ও শিক্ষা ব্যবস্থার এই মাত্রাতিরিক্ত ধ্বংস ফিলিস্তিনিদের জন্য গাজাকে 'অবাস্তব' বা বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে। পুনর্গঠন অসম্ভব হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক সমাধান কঠিন হয়ে পড়বে। ব্যাপক ধ্বংসের পাশাপাশি, পরিবেশগত ক্ষতিও নাটকীয়ভাবে খারাপ হয়েছে (জুন ২০২৪ থেকে), যা জনস্বাস্থ্য এবং পানীয় জলের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে এবং মানবিক সংকটকে আরও গভীর করবে।
শিক্ষাব্যবস্থার বিনাশ
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা আজ ধ্বংসের শিকার। গাজার ৯৭ শতাংশ স্কুল ভবনের কোনো না কোনো স্তরের ক্ষতি হয়েছে বলে জানা যায়। এর মধ্যে ৭৬.৬ শতাংশ স্কুল ভবন সরাসরি আক্রমণের শিকার হয়েছে। ৫৬৪টি স্কুল ভবনের মধ্যে প্রায় ৯১.৮ শতাংশের হয় সম্পূর্ণ পুনর্নির্মাণ অথবা বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন হবে। শিক্ষা ব্যবস্থার এই বিনাশ ফিলিস্তিনি সমাজের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছে, কারণ এটি শুধু ভবন ধ্বংস নয়, একটি প্রজন্মের জ্ঞান ও বিকাশের পথ বন্ধ করে দিয়েছে।
৪. মৃত্যুর প্রতীক্ষা: মানবিক বিপর্যয় ও কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ
দুর্ভিক্ষ: একটি মানব-সৃষ্ট ট্র্যাজেডি:
গাজায় মানবিক বিপর্যয় এমন এক স্তরে পৌঁছেছে, যা বিশ্বকে স্তম্ভিত করেছে। গাজা সিটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষ (Famine) নিশ্চিত হয়েছে। জাতিসংঘের সংস্থাগুলি জানিয়েছে, বিপর্যয়কর ক্ষুধা, তীব্র অপুষ্টি এবং গণমৃত্যু—এই তিনটি মানদণ্ডই গাজা সিটিতে অতিক্রম করেছে। এটি 'অনাহারে ধীর, ইচ্ছাকৃত মৃত্যু' হিসেবে বর্ণিত হয়েছে।
বর্তমানে গাজার প্রায় প্রতিটি মানুষের জরুরি মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। দুই বছরের সংঘাতের কারণে দুই মিলিয়নেরও বেশি ফিলিস্তিনি পর্যাপ্ত খাদ্য ও জলের অভাবে ভুগছেন। আইআরসি (International Rescue Committee)-এর কর্মীরা জানাচ্ছেন, কিছু এলাকায় শিশুরা সারাদিনের জন্য একটি মাত্র শসা ভাগ করে খায়, বা এতটাই দুর্বল যে সাহায্যের জন্য হাঁটার শক্তিও হারিয়ে ফেলে।
আর্ন্তজাতিক উদ্ধার কমিটি (IRC)-এর ডেভিড মিলিব্যান্ড এই পরিস্থিতিকে "মানব-সৃষ্ট বিপর্যয় যা সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধযোগ্য" হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই বিপর্যয়ের প্রতিক্রিয়ায়, ইউনিসেফ তীব্রভাবে অপুষ্টিতে ভোগা ৩,০০০-এর বেশি শিশুর জন্য RUTF (Ready-to-Use Therapeutic Food) সরবরাহ করেছে। তবে এই জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা খাদ্য সরবরাহ করা হলেও, এটি রোগের মূল কারণ (অবরোধ, সংঘাত) দূর করতে পারে না। চলমান সংঘাত ও অবরোধের মুখে, এটি একটি অস্থায়ী সমাধান মাত্র।
অবরোধের কঠোরতা এবং ত্রাণ সরবরাহে বাধা
দুর্ভিক্ষের মূল কারণ হিসেবে কাজ করছে প্রায়-সম্পূর্ণ অবরোধ। ইসরায়েলের বর্তমান কঠোর অবরোধের কারণে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা সামগ্রী এবং মানবিক সহায়তা প্রবেশ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুযায়ী ইসরায়েলের মানবিক সহায়তা সরবরাহকে সহজতর করার আইনি বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও, তারা বারবার এই সহায়তায় বাধা দিচ্ছে। এই অবরোধ এবং ইচ্ছাকৃতভাবে ত্রাণ বিতরণকে কঠিন করে তোলার ফলে গাজার বেসামরিক জনগণের উপর চরম সংকট নেমে এসেছে।
ত্রাণ সংস্থাগুলোর পক্ষে কাজ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। চলমান বোমা হামলা, যোগাযোগের পতন এবং জীবনধারণের উপায় নষ্ট হওয়ায় গাজা সিটিতে আইসিআরসি (ICRC) এবং এমএসএফ (MSF) সহ বেশ কয়েকটি সাহায্য সংস্থা সাময়িকভাবে তাদের কার্যক্রম স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছে। ফলস্বরূপ, উত্তর গাজায় রান্না করা খাবারের সরবরাহ ৭০ শতাংশ কমে গেছে। এছাড়া, ওয়াটার, স্যানিটেশন ও হাইজিন (WASH) অংশীদারদের মতে, দশ লাখ মানুষ প্রতিদিন জরুরি ন্যূনতম (ছয় লিটার) পানীয় জলের চেয়েও কম জল পাচ্ছে।
৫. নীরব যুদ্ধাপরাধ: স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অন্তিম শ্বাস
হাসপাতালের ধ্বংস ও পতনশীল পরিষেবা:
গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এখন মৃত্যুর শেষ প্রান্তে। গাজার ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে মাত্র অর্ধেক আংশিকভাবে কাজ করছে, যা রোগী এবং আহতদের বিপুল চাপ সামলাতে সম্পূর্ণ অক্ষম। এই হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রী ও লোকবলের তীব্র অভাব রয়েছে। গাজা সিটির ১১টি আংশিকভাবে কার্যকরী হাসপাতালের মধ্যে মাত্র পাঁচটি নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট (NICU) ধরে রেখেছে।
এই NICU-গুলোর করুণ দশা অত্যন্ত উদ্বেগজনক: ৪০টি ইনকিউবেটরের ধারণক্ষমতা ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে, যার অর্থ ৮০টি পর্যন্ত নবজাতক অতিরিক্ত ভিড়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছে। এই শিশুরা জেনারেটর এবং চিকিৎসা সরঞ্জামের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল।
এদিকে, গুরুতর আহত রোগীদের স্থানান্তরের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুমান করে যে ১৫,৬০০ গুরুতর অসুস্থ বা আহত রোগীর জীবন রক্ষাকারী বিশেষায়িত যত্নের জন্য স্থানান্তরের প্রয়োজন। অথচ ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত মাত্র ৭,৮০২ জন রোগী (যার মধ্যে ৫,৩৬৯ জন শিশু) বিদেশে স্থানান্তরিত হতে পেরেছেন। স্থানান্তরের এই বিপুল ব্যবধান নির্দেশ করে যে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত, কারণ গাজার ধ্বংসপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় তাদের বাঁচার কোনো আশা নেই। ইউরোপ ও কানাডার ২৫ জন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেডিক্যাল করিডোর পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানালেও পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়নি।
স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর আঘাত এবং ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি
স্বাস্থ্যকর্মীরা গাজায় কেবল চিকিৎসা দিচ্ছেন না, তারাই নিজেদের জীবন হারাচ্ছেন। প্যাডিয়াট্রিশিয়ান ড. আলা আল-নাজ্জারের মর্মান্তিক ঘটনাটি এর প্রমাণ—যিনি তার চিকিৎসক স্বামী এবং নয়টি সন্তানকে হারান। ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতালের পরিচালক সিনিয়র কার্ডিওলজিস্ট ড. মারওয়ান আল-সুলতানও নিহত হন। তার মৃত্যুর ফলে গাজা উপত্যকায় মাত্র একজন সিনিয়র কার্ডিওলজিস্ট অবশিষ্ট থাকেন।
উচ্চ প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের এই হত্যাকাণ্ড কেবল বর্তমানের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে না, বরং গাজার ভবিষ্যতের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান (institutional memory) এবং বিশেষজ্ঞতাকে চিরতরে মুছে দেয়। বিশেষজ্ঞদের মৃত্যু মানে প্রজন্ম ধরে সঞ্চিত চিকিৎসা জ্ঞানের সমাপ্তি, যা পুনর্গঠন প্রচেষ্টায় ভয়াবহ শূন্যতা সৃষ্টি করবে।
এই পরিস্থিতিতে, ইসরায়েলের ৬০০-এর বেশি চিকিৎসা পেশাদাররা প্রকাশ্যে তাদের সহকর্মীদের হত্যা এবং স্বাস্থ্য অবকাঠামো ধ্বংসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তারা এই হামলাগুলোকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
৬. ট্রমার উত্তরাধিকার: শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক নরক
গাজা: শিশুদের জন্য পৃথিবীতে নরক:
ইউনিসেফ গাজাকে এর এক মিলিয়ন শিশুর জন্য "পৃথিবীতে নরকের বাস্তব প্রতিমূর্তি" হিসেবে বর্ণনা করেছে। এই যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে কোনো শিশুই ট্রমার ছাপ ছাড়া বেরিয়ে আসতে পারবে না। কমপক্ষে ৬৩,০০০ শিশু নিহত বা আহত হয়েছে, এবং আরও অনেকে অনাহারের দ্বারপ্রান্তে।
৭ বছর বয়সী শিশু কিয়ামারের (Qamar) গল্প এই ভয়াবহতা তুলে ধরে। জাবালিয়া ক্যাম্পে হামলায় পায়ে আঘাত পাওয়ার পর, অবরোধের কারণে হাসপাতালে চিকিৎসা না পাওয়ায় ২০ দিন পর সংক্রমণ হওয়ায় তার পা কেটে ফেলতে হয়। এরপর একটি সদ্য অঙ্গহানি হওয়া শিশুকে ছিন্ন তাঁবুতে করে দক্ষিণে যেতে বাধ্য করা হয়। সেখানে বোমা হামলার নিয়মিত শব্দ তার ট্রমা আরও বাড়িয়ে তোলে। তার জন্য কৃত্রিম অঙ্গ বা মানসিক সহায়তার কোনো ব্যবস্থা নেই।
তথাকথিত "নিরাপদ অঞ্চল" (যেমন আল-মাওয়াসি) মোটেও নিরাপদ নয়। শিশুরা ঘুমন্ত অবস্থায় মারা যাচ্ছে বা পঙ্গু হচ্ছে। বেসামরিকদের জন্য কোনো স্থানই নিরাপদ না থাকার অর্থ হলো, সংঘাতের কোনো 'সীমা' নেই। এই নিরাপত্তা হারানোর অনুভূতি শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশে গভীর এবং স্থায়ী অবিশ্বাস ও ভয়ের জন্ম দেবে।
মনস্তাত্ত্বিক ট্রমার আন্তঃপ্রজন্মীয় সঞ্চালন
গবেষণায় দেখা গেছে, যুদ্ধের সংস্পর্শে আসা বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) হতে পারে। গাজাবাসীর মধ্যে প্রতিনিয়ত ভয়াবহতার কারণে এই হার আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শিশুরা, যারা তাদের সমালোচনামূলক বিকাশের পর্যায়ে রয়েছে, তারা দীর্ঘমেয়াদী মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকিতে রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা।
গাজার সংঘাতের মনস্তাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক এবং এপিজেনেটিক (Epigenetic) দিকগুলি ট্রমার আন্তঃপ্রজন্মীয় সঞ্চালনের দিকে পরিচালিত করতে পারে। এর অর্থ হলো, আজকের কষ্ট আগামী প্রজন্মকেও প্রভাবিত করবে। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপক ক্ষতি নিশ্চিত করে যে গাজায় শৈশবকে পদ্ধতিগতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদী ট্রমা এবং শিক্ষার অভাবের এই সমন্বয় এমন একটি ক্ষতিগ্রস্ত প্রজন্ম তৈরি করবে, যারা কেবল মানসিক দিক থেকে নয়, সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবেও দুর্বল হবে। এই ট্রমা সহিংসতা ও সংঘাতের চক্রকে আরও দৃঢ় করতে পারে।
৭. ধ্বংসের পরেও: দায়বদ্ধতা, প্রতিরোধ এবং ভবিষ্যতের আহ্বান
গাজার দুই বছরের ধ্বংসলীলা প্রমাণ করে যে সামরিক সমাধান কেবল ধ্বংসই নিয়ে আসে। এই সংকট এখন দায়বদ্ধতার প্রশ্ন তুলেছে। জাতিসংঘ কমিশন গাজায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জেনোসাইড করার অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে। একই সঙ্গে, জাতিসংঘের রেজোলিউশন সংঘাতের মূল কারণগুলি তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে 'জাতীয়, জাতিগত, বর্ণগত বা ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে পদ্ধতিগত বৈষম্য ও দমন'।
যে পরিস্থিতিতে দুর্ভিক্ষ নিশ্চিত হয়েছে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়েছে, সেখানে ইউনিসেফ এবং আইআরসি উভয়ই অবিলম্বে, অপ্রতিরোধ্য মানবিক প্রবেশাধিকার এবং একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়েছে, যা জীবন রক্ষার একমাত্র উপায়। গাজাবাসীর জন্য, বিশেষত শিশুদের জন্য, মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা কার্যক্রম এবং আন্তঃপ্রজন্মীয় ট্রমা মোকাবিলার জন্য নিবিড়, দীর্ঘমেয়াদী হস্তক্ষেপ অত্যাবশ্যক।
সামরিক সংঘাতের দীর্ঘমেয়াদী মূল কারণগুলির (যেমন পদ্ধতিগত বৈষম্য) সমাধান না করে কোনো শান্তি পরিকল্পনা স্থায়ী হবে না। অবকাঠামোগত এবং মানসিক ট্রমা এত গভীর যে মানবিক সহায়তা বা স্বল্পমেয়াদী যুদ্ধবিরতি যথেষ্ট নয়। একটি স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া গাজাবাসীর জন্য কেবল ধ্বংস ও ট্রমার চক্রই অবশিষ্ট থাকবে। এই সংঘাতটি বিশ্ববাসীর চোখের সামনে 'মানব-সৃষ্ট বিপর্যয়' হিসেবে উন্মোচিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগ না করার ফলে ভবিষ্যতের সংঘাতের ক্ষেত্রে একটি বিপজ্জনক নজির তৈরি হবে, যেখানে জেনোসাইড এবং যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রগুলি দায়মুক্তি পেতে পারে। আন্তর্জাতিক মহলের নীরবতা এবং ভেটো ক্ষমতা ব্যবহারের কারণে সৃষ্ট এই মানবিক বিপর্যয়ের নৈতিক দায়ভার বহুলাংশে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপরও বর্তায়।