প্রকাশিত :  ০৭:১১
০৩ অক্টোবর ২০২৫

আন্তর্জাতিক ক্ষোভের ঝড়: ইসরায়েলি নৌবাহিনীর হাতে আটক গাজা ফ্লোটিলা, গ্রেটা থানবার্গসহ শতাধিক অ্যাক্টিভিস্ট গ্রেপ্তার

✍️ নিজস্ব প্রতিবেদক

আন্তর্জাতিক ক্ষোভের ঝড়: ইসরায়েলি নৌবাহিনীর হাতে আটক গাজা ফ্লোটিলা, গ্রেটা থানবার্গসহ শতাধিক অ্যাক্টিভিস্ট গ্রেপ্তার
গাজায় মানবিক সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করা ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ (GSF)-এর জাহাজগুলো আন্তর্জাতিক জলসীমা থেকেই আটক করেছে ইসরায়েলি নৌবাহিনী। এ সময় সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থানবার্গসহ প্রায় ৪৪৩ জন অ্যাক্টিভিস্টকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঘটনাটি কেবল মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নয়, বিশ্ব কূটনীতিতেও ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে।
আটক অভিযান: আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইসরায়েলের পদক্ষেপ
প্রথম দিকের জাহাজগুলোকে গাজা উপকূল থেকে প্রায় ৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে এবং বাকিগুলোকে আরও কাছে এসে আটকানো হয়। আন্তর্জাতিক আইনে এই জলসীমার ওপর ইসরায়েলের কোনো এখতিয়ার নেই। তবুও ইসরায়েল দাবি করছে, জাহাজগুলো “সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে যাচ্ছিল এবং বৈধ নৌ-অবরোধ লঙ্ঘন করছিল।”
ইসরায়েলের প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, থানবার্গ জাহাজের ডেকে বসে আছেন এবং সেনারা তাকে পানি ও একটি জ্যাকেট দিচ্ছে। ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আটককৃত সবাইকে আশদোদ বন্দরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং তারা “নিরাপদ ও সুস্থ আছেন।”
অন্যদিকে GSF অভিযোগ করেছে, আটককৃতদের অনেককে জল কামান দিয়ে আক্রমণ করা হয়েছে এবং পুরো আটক প্রক্রিয়াটি ছিল “অবৈধ ও নৃশংস।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: ক্ষোভ, নিন্দা ও কূটনৈতিক টানাপোড়েন
ঘটনার পর কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেট্রো একে সরাসরি “আন্তর্জাতিক অপরাধ” আখ্যা দিয়ে কলম্বিয়ায় থাকা বাকি ইসরায়েলি কূটনীতিকদের বহিষ্কার করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি ২০২০ সাল থেকে কার্যকর থাকা কলম্বিয়া-ইসরায়েল মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিও বাতিল করেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেছেন, “গাজায় ইসরায়েলের অবরোধ বেআইনি, আর এই দশকব্যাপী দায়মুক্তির অবসান ঘটাতেই হবে।”
তবে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি ভিন্ন অবস্থান নিয়ে বলেন, “আমি মনে করি, এই ধরনের উদ্যোগ ফিলিস্তিনি জনগণের কোনো উপকারে আসে না।”
ইউরোপ ও বিশ্বের রাস্তায় সংহতি ও প্রতিবাদ
ইসরায়েলের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে গ্রিস, ইতালি, জার্মানি, তিউনিসিয়া ও তুরস্কে হাজারো মানুষ বিক্ষোভ করেছেন। ইতালির প্রধান ট্রেড ইউনিয়ন CGIL গাজার প্রতি সংহতি জানাতে এবং ইতালীয় সরকারের “আন্তর্জাতিক জলসীমায় কর্মীদের পরিত্যাগ” নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ ধর্মঘটের সমর্থন ঘোষণা করেছে।
পাকিস্তান, বলিভিয়া ও মালয়েশিয়াও ইসরায়েলের পদক্ষেপকে কঠোর সমালোচনা করেছে। আয়ারল্যান্ডের উপ-প্রধানমন্ত্রী সাইমন হ্যারিস একে “উদ্বেগজনক” আখ্যা দিয়ে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন। আটককৃতদের মধ্যে সাতজন আইরিশ নাগরিক রয়েছেন।
জাতিসংঘের অবস্থান: অবরোধ প্রত্যাহারের দাবি
জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক ইসরায়েলকে অবিলম্বে গাজার অবরোধ তুলে নিতে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “ইসরায়েলকে অবশ্যই নিরপেক্ষ মানবিক ত্রাণ প্রকল্পে কোনো বাধা ছাড়াই সহযোগিতা করতে হবে।”
এদিকে জাতিসংঘ-সমর্থিত IPC (ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন) গত মাসে নিশ্চিত করেছে, গাজায় বর্তমানে দুর্ভিক্ষ চলছে। সংস্থার মতে, এটি সরাসরি ইসরায়েলের “পদ্ধতিগত বাধা” নীতির ফল। তবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এই দাবিকে “ডাহা মিথ্যা” বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
গ্রেটা থানবার্গের প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলের সমালোচনার জবাবে গ্রেটা থানবার্গ বলেন:
“আমি মনে করি না কেউ প্রচারের জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করবে। আমরা গাজায় মানবিক সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি।”
তার এই অবস্থান বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। মানবিক আন্দোলনে তরুণ প্রজন্মের সম্পৃক্ততাকে নতুনভাবে সামনে এনেছে এই ঘটনা।
মানবিক ত্রাণ কি এখন যুদ্ধক্ষেত্রের অস্ত্র?
এক মাস আগে স্পেন থেকে যাত্রা করা ফ্লোটিলার উদ্দেশ্য ছিল কেবল খাদ্য ও ওষুধ গাজায় পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু বারবার ইসরায়েলের বাধা প্রমাণ করছে, গাজার মানবিক সংকট এখন রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলের অংশে পরিণত হয়েছে।
ইসরায়েল বলছে, তারা হামাসের হাতে সাহায্য পৌঁছানো রোধ করছে। অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্থাগুলো দাবি করছে, সাহায্য আটকে দেওয়ায় সাধারণ মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা যাচ্ছে। এই বিতর্কই গাজা সংকটকে আরও জটিল করে তুলছে।
গাজা ফ্লোটিলা আটক শুধু একটি আঞ্চলিক ঘটনাই নয়, বরং এটি বিশ্ব কূটনীতির নতুন উত্তেজনা তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত ইসরায়েলি নীতির বিপরীতে দাঁড়িয়েছে লাতিন আমেরিকা ও বহু ইউরোপীয় দেশ। আন্তর্জাতিক মহল এখন প্রশ্ন তুলছে—মানবিক সাহায্য কি রাজনৈতিক অস্ত্রের শিকার হচ্ছে?
গাজা উপত্যকায় দুর্ভিক্ষ ও অবরোধ চলতে থাকলে, সামনে আরও ফ্লোটিলা উদ্যোগ আসবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তবে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—গাজার মানুষ কি কখনো অবরোধ ভেঙে মুক্ত নিঃশ্বাস নিতে পারবে?

Leave Your Comments




মত-বিশ্লেষণ এর আরও খবর