প্রকাশিত :  ১৩:৩২
০২ অক্টোবর ২০২৫

সোশ্যাল মিডিয়া: সংযোগের আশীর্বাদ ও মনস্তাত্ত্বিক ফাঁদ

সোশ্যাল মিডিয়া: সংযোগের আশীর্বাদ ও মনস্তাত্ত্বিক ফাঁদ

​ভার্চুয়াল সমাজের দ্বিমুখী তলোয়ার

বর্তমান যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়া মানবজীবনের এক অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। এটি আন্তঃক্রিয়ামূলক ওয়েব ২.০ প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে গঠিত, যা বিশ্বজুড়ে ভার্চুয়াল কমিউনিটি তৈরি করে। এর জীবনীশক্তি হলো ব্যবহারকারী-সৃষ্ট বিষয়বস্তু—যেমন পাঠ্য, ডিজিটাল চিত্র, ভিডিও এবং অন্যান্য অনলাইন ইন্টারঅ্যাকশনের মাধ্যমে সৃষ্ট ডেটা (উপাত্ত)। ফেসবুক, এক্স (টুইটার), ইনস্টাগ্রাম এবং লিঙ্কডইন-এর মতো প্ল্যাটফর্ম এখন তথ্য আদান-প্রদান, কনটেন্ট তৈরি ও প্রচারের শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশেও সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার এখন আকাশচুম্বী। গুগলের তথ্য অনুযায়ী, ভুয়া ও আসল মিলিয়ে দেশের ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৬ কোটি ৬৩ লক্ষেরও বেশি। বিশেষত তরুণ প্রজন্ম এই মাধ্যমে সর্বাধিক সময় ব্যয় করছে; উদাহরণস্বরূপ, ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীদের প্রায় ৫৯ শতাংশই ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণী। এসব পরিসংখ্যান প্রমাণ করে, সোশ্যাল মিডিয়া শুধু যোগাযোগের ক্ষেত্র নয়, বরং ব্যবসা, জনমত গঠন এমনকি রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারেরও এক মৌলিক ভিত্তি হয়ে উঠেছে।

গবেষণা বলছে, সামাজিক মাধ্যম একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, যা সঠিক ও কার্যকর উপায়ে ব্যবহার করা গেলে আশীর্বাদে পরিণত হতে পারে। তবে এর অপরিমিত, অসচেতন ও নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহার সমাজ এবং বিশেষত ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতে পারে। এই প্ল্যাটফর্ম দৈনন্দিন জীবনকে এমন এক ভার্চুয়াল জগৎকে কেন্দ্র করে আবর্তিত করে যেখানে ব্যবহারকারী অনিচ্ছায় নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হন। ফলস্বরূপ, ডিজিটাল যুগে সামাজিক মাধ্যম অপরিহার্যতা ও মনস্তাত্ত্বিক ফাঁদের মধ্যে এক সূক্ষ্ম সীমারেখাকে মুছে দিয়েছে, যার গভীর বিশ্লেষণ অত্যন্ত জরুরি।

​২. সংযোগ ও ক্ষমতায়ন: সোশ্যাল মিডিয়ার অনিবার্য সুবিধা

সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের বহুমাত্রিক সুবিধা মূলত সংযোগের গতি ও বিস্তৃতির ওপর নির্ভরশীল, যা সমাজ, অর্থনীতি ও শিক্ষাক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে।

​ক. যোগাযোগ ও নেটওয়ার্কিং-এর বৈপ্লবিক মাধ্যম

সোশ্যাল মিডিয়ার প্রথম ও প্রধান সুবিধা হলো কানেক্টিভিটি (Connectivity)। এটি ভৌগোলিক দূরত্বকে তুচ্ছ করে বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে বন্ধু, পরিবার বা সহকর্মীর সঙ্গে সহজে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব করেছে। একই আগ্রহ বা লক্ষ্য ভাগাভাগি করা নতুন মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনও সহজ হয়েছে। এর মাধ্যমে নেটওয়ার্কের পরিধি বাড়ে, বিভিন্ন শিল্প বা পেশার বিশেষজ্ঞ ও প্রভাবশালীদের কাছ থেকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণা জানা যায়। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মান উন্নত হয় এবং প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা অর্জন করা সম্ভব হয়।

এছাড়া, নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বা মতাদর্শের ভিত্তিতে সম্প্রদায় বা কমিউনিটি গঠনে এটি অত্যন্ত কার্যকর। দুর্যোগ বা সংকটময় সময় দ্রুত সহায়তা চাওয়া ও সামাজিক সমর্থন আদান-প্রদান করাও সম্ভব হয়।

​খ. জ্ঞান, শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি

শিক্ষাক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ার অবদান অনস্বীকার্য। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে অভিজ্ঞ পেশাজীবীদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছেন। বিশ্বব্যাপী ঘটনাবলীর দ্রুত তথ্য ও সংবাদ সংগ্রহেও সোশ্যাল মিডিয়া শক্তিশালী ভূমিকা রাখে। প্রথাগত মিডিয়া অনেক সময় পক্ষপাতদুষ্ট হলে, সোশ্যাল মিডিয়া প্রায়শই বাস্তব তথ্য ও আপডেট সরবরাহ করে। সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা, এনজিও বা সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে জোর প্রচারণা চালানো—এসব ক্ষেত্রেও এটি সহায়ক ভূমিকা রাখে।

​গ. অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ও নারীর অগ্রগতি

সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সাশ্রয়ী এবং কার্যকর প্রচারণার (SMM - Social Media Marketing) সুযোগ এনে দিয়েছে। বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ এবং অনলাইন ব্যবসাগুলো সহজেই বিপুল গ্রাহকের কাছে পৌঁছতে পারছে।

বাংলাদেশে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নেও এর প্রভাব লক্ষণীয়। ই-কমার্স খাতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। অনেক নারী উদ্যোক্তা অনলাইনে পণ্য বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। সরকারের উদ্যোগেও তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে। বর্তমানে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৮ শতাংশে পৌঁছেছে। সোশ্যাল মিডিয়া এই অগ্রগতিকে আরও ত্বরান্বিত করছে।

তবে মনে রাখতে হবে, অনলাইন সংযোগ বাস্তব জীবনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিকল্প নয়। গুণগত সম্পর্কের পরিবর্তে সোশ্যাল মিডিয়া প্রায়শই সংখ্যাগত সংযোগকে উৎসাহিত করে, যা মানসিক সুস্থতার জন্য যথেষ্ট নয়।

​৩. মনস্তত্ত্বের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ: আসক্তি ও মস্তিষ্কের রসায়ন

অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার উদ্বেগ, হতাশা ও একাকিত্বসহ নানা মানসিক সমস্যার জন্ম দেয়।

​ক. ডোপামিন লুপের ফাঁদ: তাৎক্ষণিক তৃপ্তির নেশা

সোশ্যাল মিডিয়ার আসক্তির মূল নিহিত রয়েছে মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সিস্টেম ও ডোপামিন নামক নিউরোট্রান্সমিটারের কার্যক্রমে। লাইক, কমেন্ট বা নোটিফিকেশনের মাধ্যমে মস্তিষ্ক উত্তেজনা অনুভব করে, যা ডোপামিন নিঃসরণ ঘটায়। বাস্তব জীবনের সুখ পেতে সময়সাপেক্ষ কাজ প্রয়োজন, কিন্তু ভার্চুয়াল জগতে তা মুহূর্তেই পাওয়া যায়। ফলে মস্তিষ্ক ভার্চুয়াল পুরস্কারে আসক্ত হয়ে পড়ে, যা জুয়া বা মাদকের মতো আসক্তির সমতুল্য।

​খ. সামাজিক তুলনা তত্ত্ব ও হীনমন্যতা

মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রায়শই অন্যদের জীবনের কেবল সেরা মুহূর্ত দেখে। এ অবস্থায় নিজের বাস্তব জীবনের সঙ্গে তুলনা করে অনেকেই নিজেকে ব্যর্থ বা অপ্রতুল মনে করে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে শারীরিক গঠন নিয়ে লজ্জা, বাদ পড়ে যাওয়ার ভয় ও আত্মমূল্যহীনতা তৈরি হয়।

গবেষণায় প্রমাণিত, নিরবচ্ছিন্ন তুলনা হতাশা, উদ্বেগ ও সিদ্ধান্তহীনতা বাড়ায়। এমনকি কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সাময়িক বিরতিতে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে।

​গ. FOMO (Fear of Missing Out) এবং মানসিক অস্থিরতা

সোশ্যাল মিডিয়ার আরেকটি সমস্যা হলো FOMO। এটি হলো অন্যেরা কী করছে তা না জানার ভয়। ক্রমাগত সংযুক্ত থাকার চাপ মানসিক অস্থিরতা তৈরি করে। ফলে শিক্ষা, শরীরচর্চা ও বাস্তব সামাজিক মেলামেশার মতো স্বাস্থ্যকর কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘুমের ব্যাঘাতও ঘটে, যা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর।

আসলে প্ল্যাটফর্মগুলোর অ্যালগরিদম ও ব্যবসায়িক মডেলই মানুষের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগায়। ব্যবহারকারীর আবেগ ও সময়কে বিজ্ঞাপনী মুনাফার পুঁজিতে পরিণত করা হয়।

​৪. ডিজিটাল সমাজের অন্ধকার কোণ: সামাজিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকি

​ক. ভুয়া খবর ও অপপ্রচার

সোশ্যাল মিডিয়া ভুয়া খবর (Fake News) ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য (Misinformation) ছড়ানোর অন্যতম মাধ্যম। ব্যবহারকারীরা প্রায়শই সত্যতা যাচাই না করেই লাইক বা শেয়ার করেন। এর ফলে চিকিৎসা সংক্রান্ত ভুয়া তথ্য থেকে শুরু করে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা পর্যন্ত সবই ছড়িয়ে পড়ে। এটি গণতন্ত্র ও সামাজিক আস্থার জন্য হুমকি।

​খ. সাইবার হয়রানি ও নিরাপত্তাহীনতা

অতিরিক্ত ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ারিং-এর কারণে পরিচয় চুরি, সাইবার বুলিং ও প্রতারণার ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষ করে নারী সাংবাদিকেরা প্রায়শই সংগঠিত সাইবার হয়রানির শিকার হন। এছাড়া, আইনগতভাবে মানহানিকর বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকারী পোস্ট সাইবার অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়, যা ব্যবহারকারীকে শাস্তির ঝুঁকিতে ফেলে।

​৫. আত্মসমীক্ষা ও প্রতিরক্ষা: ভার্চুয়াল জগৎ নিয়ন্ত্রণের উপায়

​ক. JOMO গ্রহণ: “মিস করার আনন্দ”

FOMO-এর বিপরীতে JOMO (Joy of Missing Out) অনুশীলন প্রয়োজন। এটি হলো স্বেচ্ছায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে বর্তমান মুহূর্তে মনোনিবেশ করার মানসিকতা। ধীরে ধীরে ডিজিটাল ডিটক্স, নোটিফিকেশন নিয়ন্ত্রণ এবং সপ্তাহে একদিন সম্পূর্ণ বিরতি নেওয়া এর কার্যকর উপায়।

​খ. ব্যক্তিগত সীমানা ও নিরাপত্তা

অপ্রয়োজনীয় তথ্য শেয়ার না করে ব্যক্তিগত সীমানা বজায় রাখা জরুরি। এটি মানসিক শান্তি বজায় রাখে ও ঝুঁকি কমায়।

​গ. মিডিয়া সাক্ষরতা ও কাঠামোগত পরিবর্তন

ব্যক্তিগত সচেতনতার পাশাপাশি সামাজিক পর্যায়ে মিডিয়া সাক্ষরতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। প্রযুক্তি কোম্পানি ও রাষ্ট্রকে ভুয়া তথ্য প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। তবে আইনি কাঠামো যেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমনে পরিণত না হয়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখা জরুরি।

সোশ্যাল মিডিয়া আজকের পৃথিবীর এক অপরিহার্য প্রযুক্তি। শিক্ষা, ব্যবসা, যোগাযোগ ও সচেতনতার ক্ষেত্রে এর অবদান অনস্বীকার্য। তবে একই সঙ্গে এটি আসক্তি, হীনমন্যতা ও সামাজিক অস্থিরতার মতো গুরুতর সমস্যাও সৃষ্টি করছে।

অতএব, ব্যক্তিগত বিচক্ষণতা (JOMO, ডিজিটাল ডিটক্স), সামাজিক পর্যায়ে মিডিয়া সাক্ষরতা বৃদ্ধি এবং রাষ্ট্রের সাইবার নিরাপত্তা শক্তিশালীকরণ—এই তিন স্তরের পদক্ষেপ একসাথে গ্রহণ করলেই ভারসাম্য আনা সম্ভব। সচেতন ব্যবহারই পারে সোশ্যাল মিডিয়ার ইতিবাচক দিককে কাজে লাগিয়ে নেতিবাচক প্রভাব কমাতে।


Leave Your Comments




বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এর আরও খবর