প্রকাশিত :  ০৬:৫৭
০২ অক্টোবর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৭:০৭
০২ অক্টোবর ২০২৫

নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থার ধ্বংস আর পুঁজিবাজারের আর্তনাদ: স্বজনপ্রীতি ও অদক্ষতার খেসারত দিচ্ছে বিনিয়োগকারীরা

নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থার ধ্বংস আর পুঁজিবাজারের আর্তনাদ: স্বজনপ্রীতি ও অদক্ষতার খেসারত দিচ্ছে বিনিয়োগকারীরা

✍️ রেজুয়ান আহম্মেদ

আস্থা হারানোর অন্ধকারে পুঁজিবাজার

বাংলাদেশের পুঁজিবাজার আজ অভূতপূর্ব সংকটের মধ্যে নিমজ্জিত। শুধু সূচকের পতন বা লেনদেনের ভাটা নয়—এটি বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাসকে চূড়ান্তভাবে ভেঙে দিয়েছে। বাজারে এক অদৃশ্য আতঙ্ক কাজ করছে, যেন প্রতিদিনই আরেকটি অচেনা অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। ২০১০ সালের ভয়াবহ ধসের স্মৃতি বিনিয়োগকারীদের মনে আবারও জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অসহায় চোখে দেখছেন—দিনের পর দিন কীভাবে তাদের কষ্টার্জিত পুঁজি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। যে বাজার একসময় মানুষের স্বপ্নকে পুঁজি করে গড়ে উঠেছিল, তা আজ যেন ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে কান্না করছে।

এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য হলো—বাজারের বর্তমান ধ্বংসযজ্ঞের প্রকৃত কারণগুলো চিহ্নিত করা এবং কেন্দ্রে থাকা নিয়ন্ত্রক দুর্বলতা, নেতৃত্বের অদক্ষতা ও স্বজনপ্রীতিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। একই সঙ্গে, সংকট থেকে উত্তরণের পথও খুঁজে বের করা।

১. আতঙ্কে বিক্রির হিড়িক ও ভেঙে পড়া আস্থা

বর্তমান বাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একধরনের উন্মত্ত বিক্রির প্রবণতা দেখা দিয়েছে। একে বলা হয় প্যানিক সেল—যেখানে লোকসান মেনেও শেয়ার বিক্রি করা হয়, শুধু এই আশঙ্কায় যে আগামীকাল হয়তো দাম আরও কমবে।

ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের পর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স (DSEX)-এর পতন বাজারের প্রতি আস্থার চূড়ান্ত ভাঙনকে প্রকাশ করছে। মাত্র কয়েক সপ্তাহে সূচক ৫৭৪ থেকে ৬৮৫ পয়েন্ট পর্যন্ত নেমে গেছে। ভালো কোম্পানির শেয়ারও বিনিয়োগকারীরা দ্রুত বিক্রি করে দিচ্ছেন, এই ভয়ে যে এগুলোও হয়তো আগামীকাল ফ্লোরে আটকে যাবে।

আরও ভয়াবহ দিক হলো—মাত্র তিন কার্যদিবসে ৮০৬টি বিও (Beneficiary Owner) অ্যাকাউন্ট সম্পূর্ণ শূন্য হয়ে গেছে। এর মানে, বিনিয়োগকারীরা শুধু আর্থিক ক্ষতিই মেনে নেননি, বরং আস্থাহীন হয়ে বাজার ছেড়েই দিয়েছেন। এটি প্রমাণ করে—পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারীদের কাছে আর নিরাপদ আশ্রয় নয়।

২. নিয়ন্ত্রকের নিষ্ক্রিয়তা ও আস্থাহীনতার শিকড়

যখন বাজারে ভয় ও অনিশ্চয়তা চরমে, তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা হওয়া উচিত স্থিতি ফিরিয়ে আনা। কিন্তু বাস্তবতা হলো—বিএসইসি (বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন) কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।

বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিশ্বাস জন্মেছে যে, বাজার হয় কারসাজিকারীদের নিয়ন্ত্রণে, নয়তো নিয়ন্ত্রক নিজেই অসহায়। আস্থাহীনতার গভীরতা এতটাই যে, বিনিয়োগকারীরা বাজারে কোনো সুশাসন খুঁজে পাচ্ছেন না।

যদি নিয়ন্ত্রক শক্তিশালী ও বিশ্বাসযোগ্য হতো, তবে লোকসান সত্ত্বেও অনেকে শেয়ার ধরে রাখতেন। কিন্তু নিষ্ক্রিয়তা আর দুর্বলতার কারণে এখন সবাই মনে করছেন—এ বাজারে টিকে থাকা মানে নিজের সঞ্চয় ধ্বংস করা।

৩. সামষ্টিক অর্থনীতির ধাক্কা: পুঁজিবাজারে নতুন আঘাত

পুঁজিবাজারের দুরবস্থা কেবল নিয়ন্ত্রকের ব্যর্থতার ফল নয়; দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থাও এটিকে দুর্বল করেছে।

৩.১ সুদের হার বাড়ার প্রভাব

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর মুদ্রানীতির কারণে সুদের হার বেড়েছে। ব্যাংকের ডিপোজিট ও বন্ড এখন অনেক বেশি লাভজনক হওয়ায় ইকুইটি মার্কেটে তারল্য কমে যাচ্ছে।

আন্তঃব্যাংক কলমানি মার্কেটে সুদের হার ৭.৫০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯.২৪ শতাংশে পৌঁছেছে; ৯০ দিনের কলমানিতে তা ১২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সরকারের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ, বেসরকারি খাতের চাহিদা বৃদ্ধি ও ডলার সংকট মোকাবিলায় রিজার্ভ খরচ—সব মিলিয়ে টাকার জোগান ভয়াবহভাবে কমে গেছে।

৩.২ সুশাসনের ঘাটতি

বিশ্বের অন্যান্য বাজারও মুদ্রানীতির চাপে থাকে, তবে আমাদের বাজারে পতন অস্বাভাবিক দ্রুত। এর মূল কারণ—আমাদের বাজার এখনও প্রকৃত অর্থে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের ক্ষেত্র নয়; বরং জল্পনা-কল্পনা ও ফাটকাবাজির ওপর নির্ভরশীল।

২০১০ সালের ধসের মূলে ছিল কালো টাকা সাদা করার সুযোগ। সেই কৃত্রিম বুদবুদ ভেঙে যাওয়ার পরও শিক্ষা না নেওয়ায় আজ আবার একই দুরবস্থা তৈরি হয়েছে।

৪. নিয়ন্ত্রকের ভেতরের অরাজকতা: নেতৃত্বহীনতা ও দুর্নীতি

বিএসইসি এখন যেন নিজের ভেতরের সংকটে জর্জরিত। কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের পদত্যাগ দাবি করেছেন। কার্যালয়ে তালা ঝোলানো, সিসি ক্যামেরা কেটে অরাজকতা সৃষ্টি—এসব প্রমাণ করে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিজেই নিয়ন্ত্রণহীন।

সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের বিরুদ্ধে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির তদন্ত চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যান রাশেদ মাকসুদ অনিয়ম উন্মোচন শুরু করতেই ভেতর থেকে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে।

যখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা দুর্নীতি, অযোগ্যতা ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ভুগে, তখন বাজার স্বাভাবিক চলবে কীভাবে? বরং এতে কারসাজিকারীদের দাপট বাড়ছে।

৫. কাঠগড়ায় নেতৃত্ব: স্বজনপ্রীতি ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি

এই ভয়াবহ পরিস্থিতির কেন্দ্রে রয়েছে নেতৃত্বের ব্যর্থতা। বিনিয়োগকারীরা প্রকাশ্যে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের অপসারণ দাবি করেছেন।

অভিযোগ রয়েছে, চেয়ারম্যান নিয়োগ হয়েছে সরাসরি স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে। তার নিয়োগকে মেধার পরিবর্তে রাজনৈতিক সম্পর্কের ফল হিসেবে দেখা হচ্ছে। এতে বাজারে যে সামান্য আস্থাও ছিল, তাও ভেঙে পড়েছে।

অন্যদিকে বাজেট নিয়ে অর্থ উপদেষ্টার মন্তব্য—"জনগণ কর দেয় কিন্তু সেবা পায় না"—বিনিয়োগকারীদের ক্ষোভ আরও বাড়িয়েছে। তারা বিশ্বাস করেন, নীতি-নির্ধারণ পর্যায়ে বসে থাকা ব্যক্তিরা বাজারের প্রকৃত সংকট উপলব্ধিই করছেন না।

৬. উত্তরণের পথ: নৈতিক শুদ্ধি ও কাঠামোগত সংস্কার

প্রশ্ন হলো—এই অন্ধকার থেকে উত্তরণের পথ কী?

৬.১ নেতৃত্ব পরিবর্তন

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ও খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে অবিলম্বে অপসারণ করতে হবে। যোগ্য, অভিজ্ঞ ও নৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া আস্থা ফিরবে না। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নিয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি।

৬.২ আইন প্রয়োগ

বাজার কারসাজি, ইনসাইডার ট্রেডিংসহ সব অপরাধে শূন্য সহনশীলতা নীতি গ্রহণ করতে হবে। অতীত ও বর্তমানের সব দুর্নীতি দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে।

৬.৩ বিনিয়োগবান্ধব করনীতি

তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য কর সুবিধা বাড়াতে হবে, উৎসে কর কমাতে হবে এবং ছোট বিনিয়োগকারীদের জন্য লভ্যাংশ আয়ের করছাড় ফিরিয়ে আনতে হবে। এতে বাজারে নতুন প্রাণ ফিরে আসবে।

পুঁজিবাজার কি শুধু লুটের ময়দান?

বাংলাদেশের পুঁজিবাজার আজ বিনিয়োগকারীদের কাছে আশার প্রতীক নয়, বরং লুটের ময়দান। যে বাজারে সৎ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর অসাধুরা পুরস্কৃত হয়, সে বাজারে কেউ আস্থা রাখবে কেন?

যখন কর্মীরাই তাদের নিয়ন্ত্রকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, তখন বোঝা যায়—অভ্যন্তরীণ পচন কতটা গভীর।

তাই দৃঢ়ভাবে বলা যায়—এখনই যদি নেতৃত্ব পরিবর্তন না হয়, দুর্নীতিবাজদের শাস্তি না দেওয়া হয় এবং স্বজনপ্রীতির অবসান না ঘটে, তবে পুঁজিবাজারের এই আর্তনাদ দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকেও বিপন্ন করবে।

এখনই শুরু করতে হবে একটি নৈতিক শুদ্ধি অভিযান।

এটাই সময়ের দাবি।


Leave Your Comments




পুঁজি বাজার এর আরও খবর