প্রকাশিত :  ১১:৪৩
০১ অক্টোবর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৫৫
০১ অক্টোবর ২০২৫

দুর্গাপূজার ইতিহাস ও বিবর্তন: পৌরাণিক ভিত্তি থেকে বিশ্বজনীন উৎসব

দুর্গাপূজার ইতিহাস ও বিবর্তন: পৌরাণিক ভিত্তি থেকে বিশ্বজনীন উৎসব

✍️ রেজুয়ান আহম্মেদ 

শারদোৎসবের মহাজাগতিক পটভূমি

​শারদীয় দুর্গোৎসব কেবল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব নয়; এটি বাঙালির জাতিসত্তা, সংস্কৃতি এবং জীবনপ্রবাহের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এই মহাপূজা একদিকে যেমন ঘরের মেয়ে উমা বা পার্বতীর কৈলাস থেকে বাপের বাড়িতে মাত্র চার দিনের জন্য আগমনের আনন্দবার্তা বহন করে, তেমনই অন্যদিকে এটি অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আদ্যাশক্তি মহামায়ার বিজয়ের চিরন্তন আখ্যান। দুর্গাপূজা কবে শুরু হয়েছে, এই প্রশ্নের উত্তর সরলরৈখিক নয়। এর ইতিহাস পুরাণ, আঞ্চলিক লোকগাথা এবং দীর্ঘ রাজনৈতিক-সামাজিক বিবর্তনের মাধ্যমে বহুমাত্রিক রূপ ধারণ করেছে। এর শিকড় অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, সময় ও স্থানের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই উৎসব তার আক্ষরিক ধর্মীয় আচারের গণ্ডি পেরিয়ে পরিণত হয়েছে এক সর্বজনীন সামাজিক মিলনমেলায়।

পুরাণের দুর্গা—কাল এবং অকাল

​দুর্গাপূজার সূচনাকাল নির্ধারণে শাস্ত্রীয় উপাখ্যানের গুরুত্ব অপরিসীম। শাস্ত্র অনুসারে, এই পূজার আদিলগ্ন বসন্তকাল হলেও, পরে বিশেষ কারণে শরৎকালে এর আরাধনা শুরু হয়।

​আদিলগ্ন: বাসন্তী পূজা ও রাজা সুরথের উপাখ্যান

​দুর্গাপূজার প্রথম ও আদি রূপটি ছিল বাসন্তী পূজা। হিন্দু ধর্মীয় ঐতিহ্য অনুসারে, দেব-দেবী বসন্ত ঋতুতে (উত্তরায়ণে) জাগ্রত থাকেন, তাই এই পূজায় দেবীর বোধন বা আবাহনের প্রয়োজন হয় না। এই পূজার উৎস বর্ণিত হয়েছে মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত 'শ্রীশ্রীচণ্ডী' বা 'দেবীমাহাত্ম্যম্' গ্রন্থে।

​পৌরাণিক আখ্যান অনুযায়ী, সত্য যুগে রাজা সুরথ শত্রুদের দ্বারা পরাজিত ও রাজ্যচ্যুত হয়ে গভীর বনে মেধস মুনির আশ্রমে আশ্রয় নেন। সেখানে তাঁর সাক্ষাৎ হয় সমাধি নামের এক বৈশ্যের সঙ্গে। উভয়েই নিজেদের হারানো গৌরব ও মানসিক শান্তি ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় মেধস মুনির নির্দেশনায় দেবী দুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করে কঠোর তপস্যা ও আরাধনা শুরু করেন। এই আরাধনার মাধ্যমেই দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাঁদের বর দেন।

​বাসন্তী পূজা একসময় সমাজের উচ্চবিত্ত বা জমিদার শ্রেণির মধ্যেই প্রচলিত ছিল। গবেষকদের ধারণা, বসন্ত ঋতুর শেষে গ্রীষ্মের শুরুতে তখন বসন্ত রোগের (গুটি বসন্ত) প্রবল প্রকোপ দেখা যেত। এই রোগের প্রকোপ প্রশমিত করার জন্য এবং সুস্থতা কামনায় মায়ের আরাধনা করার চল ছিল, যা এই পূজাকে প্রাচীন কৃষিভিত্তিক সমাজ ও জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে যুক্ত করে। যদিও বাঙালি তার এই আদি দুর্গাপূজাকে সম্পূর্ণ ভুলে যায়নি, কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এটি তার গরিমা হারায়।

​সময়ের ব্যতিক্রম: রামের অকালবোধন

​শারদীয় দুর্গোৎসবের জনপ্রিয়তার মূল কারণ হলো 'অকালবোধন'-এর কাহিনি। শরৎকালকে প্রথাগতভাবে দক্ষিণায়ণ বা দেব-দেবীদের নিদ্রার কাল হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রচলিত আখ্যান অনুসারে, রাবণ বধের জন্য রামচন্দ্রকে অসময়ে (অকালে) দেবী দুর্গার কৃপা লাভের জন্য আরাধনা করতে হয়েছিল, যা অকালবোধন নামে পরিচিত। রামায়ণের অনুবাদক বাঙালি কবি কৃত্তিবাস ওঝা কালিকাপুরাণ ও বৃহদ্ধর্মপুরাণের কাহিনি অবলম্বনে তাঁর কৃত্তিবাসী রামায়ণ-এ এই আখ্যানটিকে যুক্ত করেন।

​এই সংযোজন ছিল বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। যদিও মূল বাল্মীকি রামায়ণে রাম কর্তৃক দুর্গাপূজার কোনো উল্লেখ নেই, তবুও কৃত্তিবাসের আবেগমথিত বর্ণনা বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনে শরৎকালের দুর্গাপূজাকে চিরস্থায়ী করে তোলে। রামের এই আরাধনা ছিল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে বিজয়ের জন্য প্রার্থনা, যা রাজা সুরথের ব্যক্তিগত দুঃখ মোচনের আখ্যানের চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক এবং সামরিক উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী। এর ফলে, উচ্চবিত্তের বাসন্তী পূজার বদলে সাধারণ মানুষের মধ্যে শারদীয় দুর্গাপূজা দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে, যা পরবর্তীকালে রাজকীয় এবং জমিদারী পৃষ্ঠপোষকতাও লাভ করে। এই সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ইঙ্গিত দেয় যে, একটি সহজবোধ্য এবং বিজয় কেন্দ্রিক লোকগাথা কীভাবে ঐতিহ্যগত ধর্মীয় বিধানকে ছাপিয়ে গিয়ে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে।

দেবী মাহাত্ম্যম্, মহিষাসুর বধ এবং পূজার কাঠামো

​দুর্গাপূজার মূল আধার হলো মহিষাসুরমর্দিনীর কাহিনি, যা চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যে রচিত মার্কণ্ডেয় পুরাণের অংশ 'শ্রীশ্রীচণ্ডী'তে (দেবীমাহাত্ম্যম্) পাওয়া যায়। এই গ্রন্থে দেবীর মধুকৈটভ, মহিষাসুর এবং শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের তিনটি প্রধান আখ্যান বর্ণিত হয়েছে। যেহেতু দুর্গাপূজা মহাপূজা হিসেবে গণ্য, তাই এই পুজোয় চণ্ডীপাঠ করা অবশ্য কর্তব্য, কারণ এটি পূজার সকল ত্রুটি দূর করে পূর্ণতা এনে দেয় বলে বিশ্বাস করা হয়। বেদের কোনো ধারাতেই মহিষাসুর বধের উল্লেখ পাওয়া যায় না; এর উল্লেখ পুরাণে আছে।

​পূজার প্রথাগত আচারগুলির মধ্যে রয়েছে নবপত্রিকা। এই নয়টি উদ্ভিদের সমন্বিত রূপটি প্রতিমা পূজার পূর্বে দেবী চামুণ্ডার আবাহন হিসেবে পূজিত হয়। এই আরাধনা প্রমাণ করে যে, প্রতিমা পূজার প্রচলনের আগে থেকেই শস্য এবং প্রকৃতির উপাসনার প্রাচীন, কৃষিভিত্তিক প্রথাকে দুর্গাপূজার কাঠামোর মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।

​পূজার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আচার হলো সন্ধিপূজা, যা অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট এবং নবমী তিথির প্রথম ২৪ মিনিট, মোট ৪৮ মিনিট ধরে অনুষ্ঠিত হয়। এই সংযোগকালে দেবী চামুণ্ডা রূপে পূজিত হন, যা দেবীর উগ্র এবং সংহারক শক্তির প্রতি আরাধনা। অপরাজিতা পূজাও দুর্গাপূজার একটি অংশ, যা বিজয়া দশমীর দিন বিসর্জনের পর করা হয়। এই দেবী বিষ্ণুমায়া ও শিবশক্তির মিশ্রণে কল্পিতা।

বাংলার মাটিতে দুর্গার আগমন—সময়রেখার সন্ধান

​দুর্গাপূজার পৌরাণিক ভিত্তি সুদূর হলেও, বাংলায় বৃহৎ পরিসরে এই উৎসবের ঐতিহাসিক প্রচলন শুরু হয় মধ্যযুগে।

​প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলায় বিস্তার

​গবেষকদের মতে, দেবী দুর্গা এবং শক্তি উপাসনার উৎস অ-ব্রাহ্মণ্য এবং অ-বৈদিক প্রথায় নিহিত। প্রাচীন ভারতীয় ধর্মগ্রন্থ, যেমন বেদের কোনো ধারাতেই মহিষাসুর বধের উল্লেখ পাওয়া যায় না। পণ্ডিতরা এই দেবী উপাসনার ধারাকে মূলত শাক্ত বা মাতৃদেবী উপাসনার সঙ্গে যুক্ত করেন।

​বাংলায় মহিষাসুরমর্দিনীর পূজার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় আনুমানিক অষ্টম শতাব্দীর ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এ। এছাড়া, নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত কালিকাপুরাণ এবং বৃহদ্ধর্ম পুরাণ-এ দুর্গাপূজার বিশদ বিবরণ রয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ হিসেবে, নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যকার সময়ে নির্মিত একাধিক মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি বাংলার নানা স্থান থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে।

​একাদশ শতাব্দীর বাঙালি পণ্ডিত ভবদেব ভট্ট তাঁর গ্রন্থে দুর্গার মাটির মূর্তি পূজার বিধান দিয়ে গেছেন। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, এই সময়ের মধ্যেই প্রতিমা পূজা বাংলার স্থানীয় সমাজে একটি প্রতিষ্ঠিত রূপ লাভ করেছিল। চতুর্দশ শতকে মিথিলার কবি বিদ্যাপতির 'দুর্গা ভক্তি-তরঙ্গিণী' এবং বাঙালি পণ্ডিত শূলপাণির 'দুর্গোৎসব-বিবেক' গ্রন্থ দুটিতে দুর্গোৎসবের কথা উল্লেখ থাকায় বোঝা যায়, এই সময় থেকেই পূজা রীতিমতো 'উৎসব'-এর রূপ নিয়েছিল।

​মধ্যযুগে বাংলায় যখন রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয় এবং হিন্দু সমাজের প্রান্তিকতা অনুভূত হয়, তখন হিন্দু সমাজের আত্ম-প্রতিষ্ঠা এবং নতুন পরিচয় নিশ্চিত করার প্রয়োজন দেখা যায়। এই সময়েই 'Warrior Goddess' রূপে দুর্গার আরাধনার উপর জোর দেওয়া হয়, যা হিন্দু সমাজের এক ধরনের 'Reassertion of Identity' হিসেবে বিবেচিত হয়।

​বাংলার প্রাচীনতম দুর্গোৎসব

​ঐতিহাসিক প্রমাণ সাপেক্ষে বাংলার প্রাচীনতম দুর্গাপূজা হিসেবে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরের পূজা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

​মল্ল রাজবংশের কুলদেবী মৃন্ময়ী দেবীর পূজা শুরু হয়েছিল ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে (মল্লাব্দ ৩০৩) মল্লরাজ জগৎমল্লের দ্বারা। এই পূজা প্রায় ১০২৪ বছরের প্রাচীন। এই পূজার কিছু স্বতন্ত্র পদ্ধতি রয়েছে, যা বাংলায় প্রচলিত সাধারণ পূজার থেকে ভিন্ন। এই পদ্ধতি 'জগৎমল্ল-প্রথা' নামে পরিচিত। এই প্রথা অনুযায়ী, প্রতিমায় লক্ষ্মী-গণেশ এবং কার্তিক-সরস্বতী স্থান পরিবর্তন করে থাকেন। এছাড়া, মৃন্ময়ী দেবীর সঙ্গে তিনটি পটে আঁকা দুর্গারও (বড়, মেজো ও ছোট ঠাকুরানি) পূজা করা হয়।

​এই স্বতন্ত্র জগৎমল্ল-প্রথা প্রমাণ করে যে, প্রাচীন রাজবংশগুলি তাদের পূজার রীতিনীতিকে কেবল ধর্মীয় আচার হিসেবে নয়, বরং আঞ্চলিক পরিচিতি এবং নিজেদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার এক নীরব প্রয়াস হিসেবে ব্যবহার করত।

​শারদীয় পূজার ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠা

​বাসন্তী পূজা প্রাচীন হলেও, ব্যাপক জাঁকজমক ও সামাজিক অংশগ্রহণের সঙ্গে শারদীয় দুর্গাপূজার প্রতিষ্ঠা ঘটে জমিদার ও রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায়। কতিপয় ঐতিহাসিকদের মতে, ষোড়শ শতাব্দীর শুরুতে (মতান্তরে ১৫১০ সাল বা ১৬শ শতকের প্রথম দিকে) রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ মহাসমারোহে শারদীয় দুর্গাপূজার প্রবর্তন করেন। বলা হয়, তিনি প্রায় আট লক্ষ মুদ্রা ব্যয় করে এই পুজো শুরু করেন, যা ছিল খ্যাতি লাভের নিমিত্তে এক বিশাল আয়োজন। এই বিপুল ব্যয়ে পূজার আয়োজন ইঙ্গিত দেয় যে, শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু থেকেই একটি ধর্মীয় আচারের বাইরে গিয়ে সামাজিক প্রতিপত্তি (Social Status) এবং প্রদর্শনের (Spectacle) মাধ্যমে পরিণত হয়েছিল।

​রাজা কংসনারায়ণের এই আড়ম্বরপূর্ণ পূজার পরে নদিয়ার ভবানন্দ মজুমদার, কোচবিহার রাজবাড়ি এবং কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারেও মহাসমারোহে দুর্গোৎসবের আয়োজন শুরু হয়। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যেই দুর্গোৎসবের সূচনা ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় বলে মনে করা হয়।

প্রতিপত্তির উৎসব: জমিদারির অন্দরমহল থেকে সর্বসাধারণের আঙিনায়

​আঠারো ও উনিশ শতকে দুর্গাপূজা তার কেবল ধর্মীয় পরিচিতি ছেড়ে সামাজিক ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি প্রদর্শনের মাপকাঠি হয়ে ওঠে।

​ঔপনিবেশিক প্রভাব ও সামাজিক প্রতিযোগিতা

​১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উত্থান ঘটে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাবে জন্ম নেয় এক নতুন বিত্তশালী জমিদার এবং বণিক (Bania) শ্রেণি। এই নব্য বিত্তশালীরা নিজেদের সামাজিক প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করতে এবং ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করতে বিপুল অর্থ ব্যয় করে দুর্গাপূজা শুরু করেন।

​রাজা নবকৃষ্ণ দেব ১৭৫৭ সালে ইংরেজদের বিজয় উপলক্ষে কলকাতায় শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন। এই সময় জমিদার বাড়ির পূজায় ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ জানানো ছিল অপরিহার্য। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা জে. জেড. হোলওয়েলের লেখা থেকে জানা যায়, অভ্যাগত ইউরোপীয়দের জন্য বিপুল খাবার-দাবার, পানীয়, এবং বিনোদনের জন্য বাইজি নাচ ও গানের আসর বসতো। এটি স্পষ্ট করে যে, ঔপনিবেশিক আমলে দুর্গাপূজা সামাজিক প্রতিপত্তি অর্জনের একটি সূক্ষ্ম মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়, যেখানে ধর্মীয় আচারকে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এই চূড়ান্ত আড়ম্বরপূর্ণ অপচয় ও সামাজিক প্রতিযোগিতার নিন্দা কালীপ্রসন্ন সিংহের 'হুতোম পেঁচার নকশা'-তেও পাওয়া যায়। তবে ব্যতিক্রমও ছিল; মালদার রতুয়ায় মুসলিম জমিদার জুহুর খান ৩২৮ বছর আগে স্বপ্নাদেশে দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন, যা উৎসবটির সর্বজনীন আবেদন এবং সাংস্কৃতিক প্রভাবকে তুলে ধরে।

​ঘরের মেয়ে উমা: আগমনী ও জাতীয়তাবাদী চেতনায়

​উপাসনার ক্ষেত্রে দুর্গা মহিষাসুরমর্দিনীর রূপে পূজিত হলেও, বাঙালি তাঁকে 'উমা' বা 'ঘরের মেয়ে' হিসেবে দেখতে ভালোবাসে। দেবী এখানে সপরিবার আসেন—সঙ্গে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ—এবং চালচিত্রে শিব, গাছপালা ও পশুপাখি নিয়ে দেবীর আগমন বাঙালির দৈনন্দিন জীবন ও প্রকৃতির সঙ্গে দেবীকে একীভূত করে তোলে। আগমনী সঙ্গীতগুলির মূল সুর হলো কৈলাস থেকে কন্যা উমার বাপের বাড়িতে মাত্র চার দিনের জন্য আগমন এবং বিজয়া দশমীতে প্রত্যাবর্তনের করুণ আবেগ।

​ঊনবিংশ শতাব্দীতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ঢেউ যখন বাংলাকে স্পর্শ করে, তখন দুর্গাপূজা কেবল ধর্মীয় রইল না। এই সময় দেবী দুর্গা হয়ে উঠলেন পরাধীন ভারতের প্রতীক, 'ভারত মাতা'। হাটখোলা দত্তবাড়িতে প্রতিমা বিসর্জনের পর আজও 'বঙ্গ আমার জননী আমার' গান গাওয়ার প্রথা এই চেতনারই নিদর্শন। এই রাজনৈতিক এবং পারিবারিক দ্বৈত রূপ উৎসবটিকে অত্যন্ত নমনীয় করে তুলেছে, যা সামাজিক বন্ধন মজবুত করার পাশাপাশি বৃহত্তর জাতীয় আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করতে সাহায্য করেছে।

​বারোয়ারি থেকে সর্বজনীন উৎসবের জন্ম

​জমিদার বাড়ির পূজায় সমাজের সব শ্রেণির মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল না, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের সামাজিক ভেদাভেদ তৈরি করত। এই ভেদাভেদ ভাঙার মাধ্যমেই সর্বজনীন পূজার সূচনা হয়।

​হুগলির গুপ্তিপাড়ায় ১৭৯০ সালে (কারো কারো মতে ১৭৬১) 'বারো জন ইয়ার' (বন্ধুর) চাঁদায় প্রথম বারোয়ারি পূজা শুরু হয়। এটি ছিল ব্যক্তিগত বা জমিদারি মালিকানা থেকে সর্বসাধারণের চাঁদার পূজার দিকে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

​কলকাতায় আধুনিক অর্থে সার্বজনীন দুর্গাপূজা শুরু হয় ১৯২৬ সালে। উত্তর কলকাতার সিমলা ব্যায়াম সমিতি সার্বজনীন এবং বাগবাজার সার্বজনীন এই আন্দোলনের পথিকৃৎ। জনশ্রুতি আছে, ১৯১৮ সালে স্থানীয় কিছু যুবক জমিদার বাড়িতে অপমানিত হওয়ার পর সর্বসাধারণের জন্য পূজার আয়োজন করার প্রেরণা পান, যা ছিল আর্থ-সামাজিক ভেদাভেদের বিরুদ্ধে এক সরাসরি সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ। এই সর্বজনীন আন্দোলন কেবল ধর্মীয় স্বাধীনতা নয়, বরং সামাজিক গণতন্ত্রায়নের প্রতীক ছিল। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩৮ ও ১৯৩৯ সালে বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন, যা এই আন্দোলনকে ব্যাপক জনসমর্থন দিয়েছিল। সার্বজনীন পূজার উত্থান দুর্গাপূজাকে একটি নাগরিক চেতনা (civic sensibility) এবং সামাজিক বন্ধন প্রতিষ্ঠার কেন্দ্রে নিয়ে আসে।

প্রতিমা শিল্পের বিবর্তন এবং আধুনিকতার স্পর্শ

​দুর্গাপূজার আচারের পাশাপাশি, প্রতিমা তৈরির শৈলীতেও ঐতিহাসিক পরিবর্তন এসেছে, যা আধুনিক থিম পূজার জন্ম দিয়েছে।

​সাবেকি চালচিত্র থেকে ডাকের সাজ

​ঐতিহ্যগতভাবে, বাংলায় দুর্গাপূজার প্রতিমায় দেবী দুর্গা ও তাঁর চার সন্তান—লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ—একটিমাত্র অর্ধচন্দ্রাকার কাঠামো বা মঞ্চে (চালচিত্র) স্থাপন করা হতো, যা একচালা প্রতিমা নামে পরিচিত। এই শৈলী পারিবারিক ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। এই প্রতিমাগুলিতে মূলত ডাকের সাজ ব্যবহার করা হতো, যা নদীয়ার কৃষ্ণনগর থেকে অর্ডার দিয়ে তৈরি করে ডাকযোগে আসতো বলে এই নাম। বিংশ শতকের শুরুতে কলকাতার কুমারটুলি প্রতিমা শিল্পের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়।

​শৈল্পিক বিপ্লব: গোপেশ্বর পাল ও 'একচালা'র ভাঙন

​বিংশ শতকের গোড়ার দিকে (আনুমানিক ১৯৩২ থেকে ১৯৩৭ সালের মধ্যে) বিখ্যাত ভাস্কর গোপেশ্বর পাল প্রতিমা নির্মাণে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনেন। তিনি দেব-দেবীকে একটি মঞ্চে না রেখে, প্রতিটি প্রতিমাকে আলাদা আলাদা মঞ্চে স্থাপন করেন, কার্যত একটি সংযুক্ত প্রতিমা থেকে পাঁচটি পৃথক মূর্তি তৈরি করেন। গোপেশ্বর পাল ইউরোপের জাদুঘরগুলিতে ভাস্কর্য দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল—দর্শকরা যেন প্রতিটি মূর্তির শৈল্পিক কারুকার্যের উপর সমান মনোযোগ দেন। এই পরিবর্তন ছিল প্রতিমা শিল্পের এক যুগান্তকারী মুহূর্ত, যা দেবীর বিগ্রহকে ধর্মীয় আচারের প্রতীকী রূপ থেকে আধুনিক, স্বতন্ত্র শিল্পকলার পর্যায়ে উন্নীত করে। যদিও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অনুরোধে তিনি এই পরিবর্তন এনেছিলেন বলে একটি জনপ্রিয় লোককথা প্রচলিত, তবে ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী গোপেশ্বর পাল তাঁর নিজস্ব শৈল্পিক ভাবনায় এই পরিবর্তন শুরু করেছিলেন।

​থিম পূজার যুগ ও সামাজিক ভাষ্য

​একবিংশ শতাব্দীতে এসে দুর্গাপূজা মণ্ডপসজ্জা, প্রতিমা এবং আলোকসজ্জার সমন্বয়ে 'থিম পূজা'-তে রূপান্তরিত হয়েছে। এখানে শিল্পের ভাবনা এবং কনসেপ্টই প্রধান হয়ে ওঠে, যেখানে বাঁশ-কাপড় থেকে শুরু করে প্লাস্টিকের বোতল, ফলের বীজ, বরফ বা ফেলে দেওয়া সামগ্রী ব্যবহার করে মণ্ডপ ও প্রতিমা তৈরি হয়।

​থিম পূজা বর্তমানে সমসাময়িক সমাজের প্রতিচ্ছবি, জনমত এবং প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, কোভিডের সময় পরিযায়ী শ্রমিক দুর্গা বা নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে ন্যায়বিচার ও আত্মরক্ষার থিমগুলিকে পুজো মণ্ডপে স্থান দেওয়া হয়েছে। এই পরিবর্তন দুর্গাপূজাকে একটি জীবন্ত, বিকেন্দ্রীভূত পাবলিক আর্ট গ্যালারি এবং সমালোচনার মঞ্চে পরিণত করেছে।

​দুর্গাপূজা এখন কেবল ধর্মীয় নয়, এটি বাংলার এক বৃহৎ শিল্প। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে মৃৎশিল্পী, ঢাকী, পটুয়া শিল্পী, তাঁতী এবং বিভিন্ন পেশাজীবীদের নিয়ে যে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়, তার মূল্যমান কয়েক কোটি টাকা। ২০২১ সালে কলকাতার দুর্গাপূজা ইউনেস্কোর Intangible Cultural Heritage of Humanity তালিকায় স্থান পাওয়ায় উৎসবটির বিশ্বজনীন স্বীকৃতি মেলে।

মহিষাসুর: আদিবাসী চেতনায় অন্য এক ইতিহাস

​দুর্গাপূজার ইতিহাস পর্যালোচনায় মহিষাসুর বধের প্রচলিত আখ্যানের বিপরীতে থাকা আদিবাসী লোকগাথা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কাহিনি দুটি ভিন্ন সভ্যতার ঐতিহাসিক সংঘাতের দিকে নির্দেশ করে।

​আর্য-অনার্য সংঘাতের লোকগাথা

​ভারতের প্রাচীনতম উপজাতিদের মধ্যে অন্যতম হলো অসুর সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায় দুর্গাপূজার সময়টিকে (যা তাদের কাছে 'দাসাই মাস') উৎসবের পরিবর্তে শোক পালনের সময় হিসেবে গণ্য করে। অসুর সম্প্রদায়ের লোকগাথা অনুযায়ী, মহিষাসুর ছিলেন একজন অত্যন্ত বলশালী, প্রজাবৎসল এবং ন্যায়পরায়ণ রাজা। আর্যদের দেবী দুর্গা ছলনার মাধ্যমে তাঁদের রাজাকে হত্যা করেছিলেন। এই শোকের কারণে তারা নবরাত্রি জুড়ে অরন্ধন পালন করে এবং ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখে, যাতে আর্যদের উৎসবের শব্দ তাদের কান অবধি না পৌঁছায়।

​হিন্দু পুরাণে দেবী দুর্গার যে প্রতিমা গড়া হয়, সেখানে তিনি গৌরবর্ণা, টিকলো নাকযুক্ত (যা আর্যদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য), যা দেবীর আরেক নাম 'গৌরী'-তে প্রতিফলিত। অন্যদিকে, মহিষাসুরের মূর্তিতে তাঁর গায়ের রঙ কালো, কোঁকড়ানো চুল, পুরু ঠোঁট—যা অনার্য বা আদিবাসী বৈশিষ্ট্য বলে মনে করা হয়। এই সাংস্কৃতিক বৈপরীত্য নির্দেশ করে যে, দুর্গাপূজার মূলে কেবল নৈতিক সংগ্রাম (সুর বনাম অসুর) নয়, বরং ঐতিহাসিক জাতিগত সংঘাত (আর্য বনাম অনার্য) এবং সাংস্কৃতিক বিজয়ের স্মৃতি নিহিত আছে।

​'হুদুড় দুর্গা' এবং পরিচয় রাজনীতি

​অসুর জাতির লোকগাথা অনুসারে, মহিষাসুর ছিলেন প্রবল শক্তিশালী এক দুর্গের রক্ষক, যার শক্তি ছিল বজ্রের মতো ('হুদুড়')। তাই তারা তাঁকে 'হুদুড় দুর্গা' (পুংলিঙ্গ) বলে অভিহিত করে।

​সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, আদিবাসী সমাজ তাদের ইতিহাস ও পরিচয় পুনর্গঠনে সক্রিয় হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড এবং ছত্তিশগড়ের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় 'মহান অসুর সম্রাট হুদুড় দুর্গা স্মরণ সভা'-র আয়োজন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি তথাকথিত ব্রাহ্মণ্যবাদী কাঠামোর বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ হিসেবে কাজ করছে এবং প্রান্তিক আদিবাসী সমাজকে তাদের ইতিহাস ও পরিচয় পুনর্গঠনে সহায়তা করছে। এই আন্দোলন বিজয়ীদের ইতিহাস এবং পরাজিতদের স্মৃতির মধ্যে চিরন্তন দ্বন্দ্বের প্রতীক।

ঐক্য, অর্থ এবং চিরন্তন আনন্দ

​দুর্গাপূজার ইতিহাস কোনো একক বিন্দুতে শুরু হয়নি; বরং এটি বহুস্তরীয় পৌরাণিক, সাংস্কৃতিক, এবং ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফল। এই উৎসবের সূচনাকে নিম্নলিখিত প্রধান স্তরে বিভক্ত করা যেতে পারে:

​১. পৌরাণিক আদিলগ্ন: বাসন্তী পূজার মাধ্যমে সত্যযুগে প্রথম আরাধনা, যা মার্কণ্ডেয় পুরাণে রাজা সুরথের উপাখ্যানে বর্ণিত হয়েছে।

২. সাংস্কৃতিক স্থানান্তর: ত্রেতা যুগে রামের অকালবোধন, যা কৃত্তিবাসের জনপ্রিয় অনুবাদের মাধ্যমে শারদীয় পূজাকে স্থায়ী করে তোলে।

৩. ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠা: দশম শতাব্দীতে মল্ল রাজবংশের মৃন্ময়ী পূজা (৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ) এবং ষোড়শ শতাব্দীতে রাজা কংসনারায়ণের হাত ধরে শারদীয় উৎসবের মহাসমারোহে প্রতিষ্ঠা।

৪. আধুনিক গণতন্ত্রায়ণ: আঠারো শতকে জমিদারদের মাধ্যমে সামাজিক প্রদর্শন এবং বিংশ শতকে বারোয়ারি ও সর্বজনীন আন্দোলনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের উৎসবে রূপান্তর।

​বর্তমানে দুর্গাপূজা কেবল ধর্মীয় আচার নয়, এটি বাঙালির সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক মিলনমেলা। এই উৎসব একই সঙ্গে ঘরের মেয়ে উমার প্রতি মমতা এবং মহিষাসুরমর্দিনীর রূপে অশুভের বিরুদ্ধে নারী শক্তির উত্থানকে প্রতীকায়িত করে। সময়ের বিবর্তনে এই চিরায়ত ঐতিহ্য আধুনিক থিম পূজা এবং বিশ্বজনীন স্বীকৃতির মাধ্যমে তার সৃজনশীলতা ও সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা প্রমাণ করেছে। এটি বাঙালির জীবনপ্রবাহে মিশে যাওয়া এক অবিচ্ছেদ্য ধারা, যা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষকে এক ঐকতানে আবদ্ধ করে।


Leave Your Comments




ধর্ম এর আরও খবর