প্রকাশিত :  ১১:০৮
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১১:১৩
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

শেভরনের পাইপলাইন থেকে কনডেনসেট চুরির নেপথ্যে কারা?

শেভরনের পাইপলাইন থেকে কনডেনসেট চুরির নেপথ্যে কারা?

সংগ্রাম দত্ত: সিলেট বিভাগের বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘদিন ধরে একটি সংঘবদ্ধ প্রভাবশালী গোষ্ঠী সিলেট-আশুগঞ্জসহ বিভিন্ন পাইপলাইন থেকে অবৈধভাবে কনডেনসেট চুরি করে আসছে। এসব চুরির ঘটনা নিয়ে অতীতে বিভিন্ন সময়ে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে, এমনকি মামলা দায়ের ও গ্রেপ্তারের ঘটনাও ঘটেছে। জানা যায়, এ চক্রের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা, নামধারী ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে তথাকথিত কিছু সাংবাদিকও জড়িত।

সম্প্রতি শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভূনবীর ইউনিয়নের শাসনের ইলামপাড়া গ্রামে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান শেভরন বাংলাদেশ লিমিটেডের পাইপলাইনে দুর্বৃত্তরা অবৈধভাবে ট্যাপিং করার সময় ছিদ্র দিয়ে গ্যাসীয় তরল বেরিয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। কনডেনসেট  জৈতাছড়া ( ছোট নদী) এর পানির স্রোতের সাথে মিশে যাওয়ায় পানিতে ভেসে ওঠা মাছগুলো সংগ্রহ করতে এসে স্থানীয় এক পরিবারের তিনজন সদস্য আকস্মিকভাবে অগ্নিদগ্ধ হন। প্রথমে তাদের শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার হাসপাতাল, পরে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে সেখান থেকে তাদেরে  ঢাকার জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাত্র ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে একই পরিবারের পিতা ও পুত্রের মৃত্যু হয়। পরিবারের আরেক সদস্য এখনো আইসিইউতে জীবন-মৃত্যুর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

ঘটনার পূর্ণ বিবরণ:

মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভুনবীর ইউনিয়নের শাসন ইলামপাড়া গ্রামে গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে আগুনে দগ্ধ হন একই পরিবারের তিনজন। বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশের কনডেনসেট পাইপলাইনে দুর্বৃত্তদের অবৈধ ট্যাপিংয়ের ফলে ছড়িয়ে পড়া তেল থেকে অগ্নিকাণ্ড ঘটে।

ঢাকা  জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২৭ সেপ্টেম্বর ভোরে মারা যান স্থানীয় বাসিন্দা বশির মিয়া (৫০) ও তাঁর ছেলে রেদোয়ান মিয়া (২০)। পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য, স্ত্রী ফারজানা আক্তার পারভীন এখনো আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।

একটি পরিবারের এই ধ্বংস শুধু ব্যক্তিগত শোক নয়; এটি দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা, কর্পোরেট দায়বদ্ধতা ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।

নিরাপত্তার প্রশ্ন:

শেভরনের মতো বহুজাতিক কোম্পানির পাইপলাইন কিভাবে এত সহজে ছিদ্র করা সম্ভব হলো? কেন তা আগেভাগে শনাক্ত হলো না? পাইপলাইনের মনিটরিং সিস্টেম কতটা কার্যকর ছিল?—এসব প্রশ্ন এখন আলোচনায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কনডেনসেট অত্যন্ত দাহ্য পদার্থ; সামান্য ফাঁসও বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

বাংলা ট্রিবিউন গত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তাদের এক প্রতিবেদনের এক স্থানে উল্লেখ করেছে যে, 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেভরনের এক কর্মচারী বলেন, দুর্বৃত্তরা ১২ ইঞ্চি পাইপ ছিদ্র করে তেল বের করার চেষ্টা করে। পরে পাইপের সেই ছিদ্র আর বন্ধ হচ্ছিল না। এ লাইনে অনেক প্রেশার থাকে। পরে ছিদ্রকারীরা সেখান থেকে পালিয়ে যায়।

কোম্পানির প্রতিক্রিয়া:

শেভরন বাংলাদেশের মিডিয়া ও যোগাযোগ ব্যবস্থাপক শেখ জাহিদুর রহমান গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন,“দুর্বৃত্তরা পাইপলাইনে ছিদ্র করে তেল চুরির চেষ্টা চালায়। এতে তেল ছড়িয়ে পড়ে এবং তাতে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব আমরা নিয়েছি।”

তবে শুধু চিকিৎসা সহযোগিতা নয়, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের দাবি উঠেছে স্থানীয়দের পক্ষ থেকে।

স্থানীয় সাংবাদিকদের অনুসন্ধান ও মন্তব্য:

দৈনিক যুগান্তর এর স্থানীয় প্রতিনিধি সৈয়দ আবু জাফর সালাউদ্দিন তার ভেরিফাইড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করে লিখেছেন যে, “স্থানীয় সাংবাদিক, বালু খেকো, রাজনৈতিক দলের নেতা ও শেভরন কোম্পানির পাহারাদার মিলে আশুগঞ্জ–কেন্দ্রিক পুরোনো তেলচুর সিন্ডিকেট এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। প্রশাসনের তৎপরতা না থাকলে নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুর দায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিতে হবে।”

দৈনিক দিনকাল এর স্থানীয় প্রতিনিধি রুবেল আহমেদ তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করে তুলে ধরেন যে, “শ্রীমঙ্গলে শেভরনের পাইপলাইনে দুর্বৃত্তদের ছিদ্রে আগুনে পিতা–পুত্রের মৃত্যু। গোপন সূত্রে জানা যায়, একটি সিন্ডিকেট স্থানীয় সাংবাদিক, বালু খেকো ও রাজনৈতিক নেতাদের হাত ধরে কয়েক মাস ধরে তেল চুরি করছে। তেল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে বিক্রি হয়। এত বড় ঘটনার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন কোনো তৎপরতা নেই।”

বাংলার ট্রিবিউন এর মৌলভীবাজার জেলার সংবাদদাতা মোঃ সাইফুল ইসলাম তার পত্রিকায় প্রকাশিত এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন যে, “এ এলাকার একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে পাইপলাইন ছিদ্র করে অপরিশোধিত তেল চুরি করছে। সর্বশেষ ছিদ্র থেকে তেল বন্ধ না হওয়ায় তা পানিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরে ভাসমান তেল থেকেই আগুন ধরে।”

পুরোনো ইতিহাস: পুনরাবৃত্ত এক অপরাধ:

প্রশ্ন হচ্ছে এই ঘটনার দায় কার? কারা এই ঘটনার অবৈধ ট্যাপিং এর সাথে জড়িত? 

এ ঘটনা নতুন নয়। বিগত দুই দশক ধরে সিলেট–আশুগঞ্জ কনডেনসেট পাইপলাইনে বারংবার একই কায়দায় ছিদ্র করে তেল চুরির ঘটনা ঘটেছে।

৩ মার্চ ২০১২, ইউনাইটেড নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম “মৌলভীবাজারে জাতীয় গ্রীড গ্যাস পাইপ লাইনে ছিদ্র করে কনডেনসেট চুরি” শীর্ষক শিরোনামে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১২ রাতে মৌলভীবাজারের রাজনগরের বালিগাঁও এলাকায় পাইপ ছিদ্র করে দুর্বৃত্তরা কয়েক শ’ লিটার কনডেনসেট চুরি করে।

প্রতিবেদনেটিতে আরো বলা হয়ে, সিলেট–আশুগঞ্জ ১৭৫ কিলোমিটার পাইপলাইনে তখন পর্যন্ত অন্তত ৭৩ বার ছিদ্র করা হয়েছিল।

স্থানীয় প্রশাসন, নিরাপত্তা কোম্পানি ও গডফাদারদের সহযোগিতায় এ তেল চুরি অব্যাহত ছিল।

২০০১–২০১২ সময়কালে মৌলভীবাজার জেলায় অন্তত ১৬ বার তেল চুরির ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। কয়েকটি ঘটনায় আগুন ধরে প্রাণহানিও ঘটে। মামলা হলেও স্থায়ী প্রতিকার হয়নি।

বিশেষজ্ঞদের মত:

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন—

কনডেনসেট অত্যন্ত দাহ্য; ক্ষুদ্র লিকও বড় বিপর্যয়ের ঝুঁকি বাড়ায়।

উন্নত মনিটরিং প্রযুক্তি (SCADA, লিক ডিটেকশন সেন্সর, প্রেশার কন্ট্রোল সিস্টেম) ছাড়া পাইপলাইন নিরাপদ নয়।

শুধু কোম্পানি নয়, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শক্ত নজরদারি, কঠোর আইন প্রয়োগ ও স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি।

প্রশাসনের ভূমিকা-

শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পরিবারকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রশাসনের ভূমিকা শুধু তাৎক্ষণিক সহায়তায় সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না; বরং দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা নিশ্চিত ও অবৈধ তেলচুরি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

ভবিষ্যতের করণীয়:

দ্রুত ও স্বচ্ছ তদন্ত: ঘটনার পূর্ণাঙ্গ ফোরেনসিক তদন্ত, অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে বিচার।

ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন: নিহত–আহত পরিবারের জন্য ন্যায়সঙ্গত ক্ষতিপূরণ ও দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা।

প্রযুক্তি উন্নয়ন: পাইপলাইনে রিয়েল–টাইম মনিটরিং ও স্বয়ংক্রিয় সেফটি ভ্যালভ।

কঠোর নজরদারি: আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দাদের নিয়মিত টহল, স্থানীয় কমিউনিটি–ভিত্তিক রিপোর্টিং সিস্টেম।

কর্পোরেট জবাবদিহিতা: শেভরনের দায় শুধু চিকিৎসা সহযোগিতা নয়; নিরাপত্তা পরিকল্পনা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা (CSR) কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন।

উপসংহার:

শ্রীমঙ্গলের পাইপলাইন ট্র্যাজেডি এক পরিবারের জীবনের অবসান ঘটালেও, এটি আসলে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল—বাংলাদেশের পাইপলাইন নিরাপত্তা এখনও ভঙ্গুর, আর অবৈধ ট্যাপিং চক্র অপ্রতিরোধ্য। যদি এখনই কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে একই ধরনের বিপর্যয় আবারও ঘটতে পারে।

পাইপলাইন কেবল জ্বালানি বহন করে না; এটি অর্থনীতির সঞ্চালনশক্তি, মানুষের জীবন ও নিরাপত্তার সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুরক্ষা নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে বড় দায়—রাষ্ট্র, কোম্পানি ও সমাজ—সবার।


Leave Your Comments




মত-বিশ্লেষণ এর আরও খবর