রেজুয়ান আহম্মেদ
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের এক দুপুরে, রাহুল ঢাকার মতিঝিল এলাকায় দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে গাড়ির হর্ন আর মানুষের কোলাহলে এক অস্থির পরিবেশ। রাহুলের বয়স ত্রিশের কোঠায় হলেও চোখে এখনো স্বপ্নের আগুন—সমৃদ্ধির স্বপ্ন। একটি ছোট আইটি ফার্মে তার চাকরি, বেতন পঞ্চাশ হাজার টাকা। এতে সংসার চলে যায় বটে, কিন্তু নিজের একটি বাড়ি, মায়ের চিকিৎসা আর সন্তানের ভবিষ্যতের স্বপ্নগুলো কেবল স্বপ্নই থেকে যায়। হাতে তার পুরোনো স্মার্টফোন, সেখানেই সে দেখছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সূচক। গত কয়েক মাস ধরে পতনের পর এখন সূচক ৫,৩৮১-এ নেমে এসেছে। বাজারে চলছে তারল্যসংকট, মুদ্রাস্ফীতি ১২% ছাড়িয়ে গেছে, আর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছে মাত্র ২১.৫ বিলিয়ন ডলারে।
রাহুলের বন্ধু আকাশ, যে একজন স্টক ব্রোকার, তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, "দোস্ত, এখনই সময়। বাজার তো ধসে গেছে, আর এটাই হচ্ছে কেনার সেরা সুযোগ। জেড-ক্যাটাগরির শেয়ারগুলো ৫২% পর্যন্ত পড়েছে।"
আকাশের কথায় রাহুলের মনে লোভ জাগল, তবে একই সঙ্গে ভয়ও পেল। কারণ, তার চাচা আব্দুল হক ২০১০ সালের ধসে সব হারিয়েছিলেন। চাচার গল্পে সে শুনেছে, কীভাবে বিশ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে নিঃস্ব হতে হয়, কীভাবে ভেঙে যায় সাজানো সংসার। ২০১০ সালে সূচক ২,৬০০ থেকে বেড়ে ৬,৮০০-তে ওঠার পর কালো টাকা আর কারসাজির কারণে ধসে পড়েছিল। এবার ২০২৫ সালেও একই সংকট—ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ প্রায় ৯০০ বিলিয়ন টাকা আর স্টক মার্কেটের পতন হয়েছে ৩৮%।
রাহুল ভাবল, "আমি কি পারব? এটা কি আমার জন্য?" কিন্তু তার মনের এক কোণে আশার আলো জ্বলছিল। সে সিদ্ধান্ত নিল, শুধু শুধু বাজারে ঢুকবে না, জেনেবুঝে প্রস্তুতি নিয়ে নামবে। এই উপন্যাস তারই যাত্রার গল্প, যেখানে লোভ, ভয়, জ্ঞান আর ধৈর্যের মাঝে সে খুঁজে পাবে তার পথ।
রাহুল বাড়ি ফিরে ল্যাপটপ খুলে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের ইতিহাস ঘাঁটতে শুরু করল। ১৯৫৪ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জ’ নামে শুরু হয়ে, যা ১৯৬৪ সালে হয় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। স্বাধীনতার পর, ১৯৭৬ সালে মাত্র ৯টি কোম্পানি নিয়ে আবারও যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৯৩ সাল থেকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে, যার প্রধান উদ্দেশ্য বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা।
কিন্তু ২০২৫ সালের চিত্র দেখে সে হতাশ হলো। এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বাজার এখনো পিছিয়ে। জিডিপির তুলনায় মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন অনেক কম। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে ডিএসই সূচক ৫,৩৮১-এ নেমেছে, একদিনেই কমেছে ৬৮ পয়েন্ট। বাজারে তারল্যসংকট, ব্রড মানি বেড়েছে মাত্র ৭.৬%। ব্রোকারেজ হাউসগুলোর অতিরিক্ত সংখ্যার কারণে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা চলছে। গত দশ মাস ধরে নতুন কোনো পুঁজি সরবরাহ নেই, আইপিও-ও আসছে না।
প্রায় ত্রিশ লাখ বিনিয়োগকারীর অধিকাংশই ক্ষুদ্র, তারা কোম্পানির আর্থিক বিবরণী বোঝেন না, গুজবের ওপর ভর করে চলেন। ২০২৫ সালে বৈশ্বিক অস্থিরতা ও ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বাজারকে আরও নড়বড়ে করে তুলেছে। রাহুল ভাবল, "এখানে লাভ করা কি আদৌ সম্ভব?" সে তার চাচাকে ফোন করল। চাচা বললেন, "বাজার এখন খুব খারাপ। ব্যাংকগুলো ৯০০ বিলিয়ন টাকা খেলাপি আর স্টক মার্কেট ৩৮% পড়েছে। খুব সাবধান।" রাহুলের মনে ভয় বাড়ল, কিন্তু সে থেমে গেল না, বরং পড়াশোনা চালিয়ে গেল।
পরদিন আকাশের সঙ্গে একটি ক্যাফেতে রাহুলের দেখা হলো। আকাশ বলল, "অতীত থেকে শেখ। ১৯৯৬ সালে ধস নেমেছিল। সূচক ৩,৬৪৯ থেকে নেমে ৪৬২-তে এসেছিল। পুরোটাই ছিল কারসাজি। আর ২০১০ সালে সূচক ২,৬০০ থেকে ৬,৮০০-তে উঠে আবার ধসে পড়ে। কারণ ছিল কালো টাকা আর মার্জিন ঋণ।" সেই ধসে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছিল, অনেকে নিঃস্ব হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। মানুষের মধ্যে 'হার্ডিং বিহেভিয়র' বা পালের মতো ছোটার প্রবণতা কাজ করে।
২০২৫-এও একই সংকট। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে সূচক নিম্নমুখী হওয়ায় আস্থার সংকট আরও বেড়েছে। ২০২৫ সালের মে মাসে বিনিয়োগকারীরা কাফন পরে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছিল। বাজারে আত্মবিশ্বাসের অভাব, টার্নওভার কম, বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে প্রায় ৭০%। রাহুলের চাচা আবার বললেন, "লোভে পড়লে সব হারাবি। ২০২৫-এর সংকটে ব্যাংক, নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) এবং স্টক—সবই ধসে পড়ছে।" রাহুল ভাবল, "আমি এই চক্র ভাঙব।" আকাশ হেসে বলল, "তাহলে নিজেকে প্রস্তুত করো।"
রাহুল বাড়ি ফিরে মাকে বলল, "মা, আমি বাজারে নামছি। কিন্তু খুব ভয় লাগছে।" মা বললেন, "বাবা, তোর চাচার মতো হোস না। ২০১০ সালের ধসে আমরা সব হারিয়েছি। এখন আবার ২০২৫-এ একই সংকট। খুব সাবধানে থাকিস।" রাহুল নিজেকে শান্ত করল, "মা, আমি আগে সব শিখব।"
রাহুল প্রথমে নিজেকে আর্থিকভাবে প্রস্তুত করল। ছয় মাসের খরচের সমান একটি জরুরি তহবিল তৈরি করল এবং উচ্চ সুদের ঋণ পরিশোধ করে দিল। সে ভাবল, "যদি ২০২৫-এর তারল্যসংকটে বাজার আরও পড়ে যায়, তাহলে আমাকে লোকসানে শেয়ার বিক্রি করতে হবে না।" সে নিজের ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা বুঝল—বয়স কম হওয়ায় সে মাঝারি ঝুঁকি নিতে পারে। কিন্তু মানসিকতা? সে জানে, ভয়ে সব বিক্রি করে দিলে লোকসান নিশ্চিত। তাই সে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ঠিক করল: অবসরকালীন সঞ্চয়, বাড়ি কেনা, সন্তানের লেখাপড়া। নিজেকে বলল, "দ্রুত ধনী হওয়ার মানসিকতাটা বাদ দিতে হবে।"
একদিন তার মা বললেন, "বাবা, সাবধান। ২০২৫-এর সংকটে তো বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নেমেছে।" রাহুল হাসল, "মা, আমি তো প্রস্তুতি নিয়েই নামছি। জ্ঞান ছাড়া এই বাজারে পা রাখব না।"
রাহুল একটি বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) অ্যাকাউন্ট খুলল। জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) আর ছবি দিয়ে অ্যাকাউন্ট তৈরি করল এবং ৫০ হাজার টাকা জমা করল। এরপর সে অনলাইন ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে শিখল—মার্কেট অর্ডার (বর্তমান দামে কেনা-বেচা) আর লিমিট অর্ডার (নির্দিষ্ট দামে কেনা-বেচা)।
প্রথম ট্রেড: একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির শেয়ার কিনল। ২০২৫-এর এই অস্থির সময়ে তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছিল। আকাশ বলল, "ভালো শুরু। এখন বিশ্লেষণ শেখা শুরু কর।" রাহুল ভাবল, "এটা জুয়া নয়, এটা বিজ্ঞান।"
রাহুল ফান্ডামেন্টাল অ্যানালাইসিস শিখল—কোম্পানির আর্থিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা। সে ব্যালেন্স শিট, ইনকাম স্টেটমেন্ট, ক্যাশ ফ্লো, পিই রেশিও, ইপিএস এবং ডিভিডেন্ড বিশ্লেষণ করতে শুরু করল। ওয়ারেন বাফেটের মতো সে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের দিকেই বেশি মনোযোগ দিল।
অন্যদিকে, টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস শিখল—প্রাইস চার্ট, মুভিং অ্যাভারেজ (এমএ), আরএসআই এবং এমএসিডি ব্যবহার করে অতীতের দাম থেকে ভবিষ্যতের গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করল। সে এমন একটি শেয়ার বেছে নিল, যার ফান্ডামেন্টাল শক্তিশালী এবং টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস অনুযায়ী প্রবেশের সঠিক সময়। কিন্তু একবার গুজবে পড়ে একটি শেয়ার কিনে ৫ হাজার টাকা লোকসান হলো। সে নিজেকে বলল, "ভুল থেকে শিখব।" ২০২৫-এর সংকটে এই ভুল অনেকেই করছে।
"সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখব না," ভাবল রাহুল। সে ২৫টি কোম্পানি বেছে নিল—বিভিন্ন খাত থেকে: ব্যাংক, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং টেক্সটাইল। শেয়ারের সঙ্গে বন্ড এবং মিউচুয়াল ফান্ডও যোগ করল। গ্রোথ শেয়ার (যেগুলো দ্রুত বাড়ছে) আর ভ্যালু শেয়ারের (কম পিই রেশিও) মধ্যে ভারসাম্য রাখল। ২০২৫-এর পতনের সময় তার পোর্টফোলিও টিকে রইল, যখন অন্যরা সব হারিয়েছিল।
আকাশ বলল, "এটা তোর দুর্গ। বাজারের উত্থান-পতনের চক্রে এটাই তোকে বাঁচাবে।"
রাহুল বুঝতে পারল, আবেগই তার সবচেয়ে বড় শত্রু। লোভে অতিরিক্ত কেনা আর ভয়ে বিক্রি করার প্রবণতা মানুষের মধ্যে থাকে। 'হার্ডিং বিহেভিয়র' বা অন্যের পেছনে ছোটা, 'লস অ্যাভার্সন' বা লোকসান সহ্য করতে না পারা এবং 'ওভারকনফিডেন্স' বা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস—১৯৯৬, ২০১০ এবং ২০২৫-এর সংকটের মূল কারণ ছিল এই আচরণগুলো। সে একটি জার্নাল লিখতে শুরু করল, যাতে তার আবেগগুলো লিপিবদ্ধ থাকে। "নিজেকে বোঝা জরুরি," ভাবল সে।
রাহুল অনেক করুণ গল্প শুনল: ২০১০-এর ধসে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া বিনিয়োগকারীরা, যারা গুজবে পড়ে মার্জিন ঋণ নিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছিল। ২০২৫-এও একই চিত্র: বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নেমেছে। কিন্তু যারা সফল হয়েছে? যারা ধৈর্য ধরে, ভুল থেকে শিখে দীর্ঘমেয়াদে লাভ করেছে। তার চাচা ফিরে এলেন, বললেন, "ভুল করিস, কিন্তু সেই ভুল থেকে শিখবি। ২০২৫-এর সংকট থেকে আমরা ঘুরে দাঁড়াব।" রাহুলের যাত্রা চলতে থাকল এবং সে তার পোর্টফোলিও বাড়াতে লাগল।
দু'বছর পর, ২০২৭ সালে। রাহুলের পোর্টফোলিওর মূল্য ১৫ লাখ টাকায় পৌঁছেছে। বাজার আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে, জিডিপি ৫০০ বিলিয়ন ডলার পার হয়েছে। বিএসইসির নতুন উদ্যোগ, মিউচুয়াল ফান্ড এবং সরকারের সংস্কারমূলক পদক্ষেপগুলো ভবিষ্যতের জন্য আশার আলো দেখাচ্ছে। রাহুল নতুন বিনিয়োগকারীদের বলে, "জ্ঞান নিয়ে বাজারে আসুন, ধৈর্য ধরুন। পুঁজিবাজার জুয়া নয়, এটি শৃঙ্খলা আর জ্ঞানের খেলা।"
রাহুলের যাত্রা এখানেই শেষ নয়, এটা চলমান—স্বপ্নের ছায়াপথে, যেখানে আলো আর ছায়া মিলে একটি সম্পূর্ণ জীবন গড়ে ওঠে।
Leave Your Comments