প্রকাশিত : ১০:৪৩
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১২:২০
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ইমরান আহমেদ চৌধুরী
জুলাই–আগস্ট ২০২৪-এর ছাত্র আন্দোলনের পর ১৫ বছরের শাসনের পতন ঘটে; নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী প্রশাসন গঠিত হয়। এক বছর পর বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে দুই পথে: প্রতিষ্ঠানভিত্তিক গণতন্ত্র না কি জনতার আদালত; আইনের শাসন না কি গুজব-নির্ভর প্রতিশোধ; বহুত্ববাদী প্রজাতন্ত্র না কি সংকীর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ।
২০২৪–২৫ সালে সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে—আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড ও ছাত্র সংগঠন নিষিদ্ধের মতো প্রয়াস—যেগুলোকে শাসকদল বলছে “রক্তক্ষয়ী দমন-পীড়নের” দায়-জবাবদিহির পূর্বশর্ত। সমর্থকরা এটিকে শৃঙ্খলা ফেরানো বলেন; সমালোচকেরা দেখেন আইনের ব্যতিক্রমী শাসন। এ দ্বন্দ্বই পরবর্তী পথচলার কেন্দ্রীয় প্রশ্ন।
গণতন্ত্রের কসাটি: প্রতিষ্ঠান বনাম ইম্প্রোভাইজেশন
এই রূপান্তরের প্রাণ হলো দ্রুত কার্যকর প্রতিষ্ঠান—স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, কার্যকর পুলিশ-আদালত, স্বাধীন গণমাধ্যম। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে যে রোডম্যাপ দিয়েছে—নিরাপত্তা খাত ও বিচারব্যবস্থার সংস্কার—এখনো অসম্পূর্ণ। সময়মতো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আস্থার নোঙর হবে; বিলম্ব অনিশ্চয়তাকে স্বাভাবিক করে তোলে।
বিশ্লেষকেরা সতর্ক করছেন—রাজনীতির মাঠে জনতাবাদী ও ইসলামপন্থী ধারার প্রভাব বেড়েছে। দ্য ডিপ্লোম্যাট বলছে, সন্ত্রাসদমন ব্যবস্থার দুর্বলতা ও নিরাপত্তা সংস্থার ক্ষমতা কমানো এমন শূন্যতা সৃষ্টি করেছে যাতে জঙ্গি ও কট্টর গোষ্ঠী সুযোগ পেতে পারে। আল জাজিরা একই সাথে উচ্ছ্বাস, নিষেধাজ্ঞা ও ট্রাইব্যুনাল—এ তিন ধারার মিলনকেই বর্তমান বাস্তবতা হিসেবে দেখায়।
জনতার বিচার: ক্লান্ত প্রতিষ্ঠানের লক্ষণ
সবচেয়ে উদ্বেগজনক প্রবণতা হলো “মব জাস্টিস”—ফেসবুক/টিকটকের গুজব থেকে উসকে ওঠা গণপিটুনি, “জনতার আদালত”, লাইভস্ট্রিমড শাস্তি। অক্সফোর্ড হিউম্যান রাইটস হাবে একে বলা হয়েছে জীবনাধিকার-লঙ্ঘন; একটি গবেষণা দেখায়, কীভাবে প্ল্যাটফর্ম-অ্যালগরিদম নৈতিক আতঙ্ককে সহিংসতায় রূপ দেয়। সংবাদমাধ্যমও একাধিক ঘটনায় জনতার হাতে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার বর্ণনা দেয়। আদালত-পুলিশ যদি দৃশ্যমানভাবে কাজ না করে, জনতা করবে—এটি ইতিহাসের কঠিন শিক্ষা।
একই সঙ্গে সাংবাদিক-লেখকদের ওপর হামলার খবরও উদ্বেগ বাড়িয়েছে। সিপিজে বলছে—কারাবন্দি/তদন্তাধীন সাংবাদিক এখনো আছেন; এই প্রেক্ষাপটে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হলো গণতন্ত্রের ফুসফুস। এইচআরডব্লিউ-এর মার্চ ২০২৫ বিবৃতিও বলেছে—রাষ্ট্র-বহির্ভূত সহিংসতা থেকেও নাগরিকদের রক্ষা করা সরকারের দায়।
বিচারব্যবস্থার ওপর চাপ: ২০২৪-এর শিক্ষা
২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্রদের আল্টিমেটাম-পরবর্তী চাপের মুখে প্রধান বিচারপতি পদত্যাগে সম্মত হন এবং সরে দাঁড়ান। ব্যক্তিপ্রীতি-অপ্রীতি যাই থাক, ভিড়ের চাপে সাংবিধানিক পদাধিকারীকে সরানো বিপজ্জনক নজির। আদালত জবাবদিহির আওতায় থাকবে—কিন্তু আইনের মাধ্যমে, অবরোধের মাধ্যমে নয়।
এ শিক্ষা ২০২৫-এ আরও জরুরি—যখন দলগতভাবে রাজনৈতিক সত্ত্বাকে বিচারের আওতায় আনার মতো নজিরবিহীন ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি আইনি পদক্ষেপে ন্যায়বিচারের মানদণ্ড, আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার, এবং “সমষ্টিগত অপরাধ” ধারণা থেকে দূরে থাকা নিশ্চিত করতে হবে।
দুর্নীতির গুঞ্জন: অভিযোগ, প্রতিবাদ, আর প্রমাণের দায়
২০২৫-এর আগস্টে এক সাবেক আমলা আটজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন; মন্ত্রিপরিষদ সচিব প্রমাণ থাকলে আইনগতভাবে দিতে বলেন; শীর্ষ দৈনিকগুলো অভিযোগকে আপাতত “অপ্রমাণিত” বলেছে। দায়টি স্পষ্ট: বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ হলে স্বচ্ছ তদন্ত, হুইসলব্লোয়ার সুরক্ষা, সম্পদ ঘোষণার বাধ্যবাধকতা, ই-প্রকিউরমেন্ট, স্বাধীন দুর্নীতি দমন সংস্থা—এগুলোই আস্থা ফেরায়।
বহুত্ববাদের পরীক্ষা
সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাই রূপান্তরের মেরুদণ্ড। ২০২৪-এর পর শত শত হামলার দলিল সামনে এসেছে; নারীর অধিকারের প্রস্তাবিত সংস্কারের বিরুদ্ধে কট্টরপন্থীদের বিরাট সমাবেশ হয়েছে। রাষ্ট্রের কর্তব্য—জনশৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের ভয়ভীতি প্রতিহত করা।
প্রবাসে রাজনীতি: বার্তা ও বিপদ
রাজনীতির ঢেউ দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও। সম্প্রতি লন্ডনে এক অন্তর্বর্তী উপদেষ্টার সফরকে ঘিরে প্রবল বিক্ষোভ, ভিডিও ভাইরাল। প্রবাসী অংশগ্রহণ গণতন্ত্রকে প্রাণ দেয়, তবে বিভাজন-গুজব আমদানিও ঘটাতে পারে। রাষ্ট্রনায়কের কাজ—সম্পর্ক রাখা, কিন্তু সংঘাত রপ্তানি না করা।
‘টু বি’—যে বাংলাদেশ হতে পারে
১. সময়াবদ্ধ, নিয়মভিত্তিক নির্বাচন।
২. রুল অব ল’ পুনর্গঠন।
৩. মব জাস্টিসে শূন্য সহনশীলতা।
৪. মতপ্রকাশের সুরক্ষা।
৫. বহুত্ববাদ রক্ষা।
৬. দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্বচ্ছতা।
‘নট টু বি’—যদি পথ হারাই
অন্য পথটি আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি: জরুরি ব্যবস্থা স্থায়ী হয়; ট্রাইব্যুনাল রাজনীতির মঞ্চে গড়ায়; গুজব সংবাদকে প্রতিস্থাপন করে; জনতা আদালতকে; সংখ্যালঘুরা ভীত; নারীর অধিকার থমকে যায়; সাংবাদিকরা আত্মনিয়ন্ত্রণে; প্রবাস রাজনীতি আরও শত্রুতা উসকে দেয়; উগ্রবাদীরা ফাঁক খুঁজে নেয়। তখন “বিপ্লব” গণতন্ত্রে উত্তরণের সেতু নয়—তার অজুহাত হয়ে ওঠে।