মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ

প্রকাশিত :  ০৯:৫০
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৯:৫৯
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত না করে ব্যাংক একীভূতকরণ কতটা ন্যায়সঙ্গত?

সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত না করে ব্যাংক একীভূতকরণ কতটা ন্যায়সঙ্গত?

✍️ রেজুয়ান আহম্মেদ 

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। টেকসই আর্থিক খাত গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো একীভূতকরণের পথে এগোচ্ছে। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এক্সিম ব্যাংক পিএলসি, ইউনিয়ন ব্যাংক পিএলসি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকসহ একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ব্যাংক খাতের দীর্ঘদিনের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য এই পদক্ষেপ জরুরি। তবে এর মাঝেই উথ্থিত হয়েছে এক বড় প্রশ্ন—একীভূতকরণের আগে কি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অধিকার ও ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা হবে না?

যে শেয়ারহোল্ডাররা আজ ব্যাংকগুলোর অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন, তাঁদের অধিকাংশই সাধারণ মানুষ। কেউ প্রবাসে শ্রমের বিনিময়ে রক্ত-ঘামে উপার্জিত টাকা পাঠিয়েছেন দেশে, কেউ শিক্ষক বা চাকরিজীবী হিসেবে বাঁচিয়ে রাখা সামান্য সঞ্চয় বিনিয়োগ করেছেন, কেউ বা অবসরের পরবর্তী জীবনের নিরাপত্তা খুঁজতে শেয়ারে ভরসা রেখেছেন। তাঁদের এই বিনিয়োগ কেবল সংখ্যায় প্রকাশিত অঙ্ক নয়, বরং জীবনের স্বপ্ন, সন্তানের ভবিষ্যৎ এবং বৃদ্ধ বয়সের চিকিৎসার নিশ্চয়তা।

কিন্তু যদি ব্যাংক একীভূতকরণের প্রক্রিয়ায় তাঁদের বিনিয়োগ উপেক্ষিত হয়, তবে তা হবে এক ধরনের অবিচার। কারণ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সেই মানুষগুলো, যাঁরা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলতে সর্বাধিক অবদান রেখেছেন।

বাংলাদেশের ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন ধরে নানা সমস্যায় জর্জরিত—অতিরিক্ত খেলাপি ঋণ, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক প্রভাব, আর্থিক অনিয়ম। এসব সমস্যা মোকাবিলা করে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতেই একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা বলছে, সংকটময় সময়ে একীভূতকরণ ব্যাংক খাতের টেকসই স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশিয়ার বহু দেশে এমন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ব্যাংক খাত টিকে আছে।

তবে বাংলাদেশে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে রয়েছে স্বচ্ছতা ও আস্থার সংকট। বিনিয়োগকারীরা আশঙ্কা করছেন—তাঁদের পুঁজির যথাযথ মূল্যায়ন ও সুরক্ষা নিশ্চিত না করেই যদি ব্যাংকগুলো একীভূত করা হয়, তবে তাঁরা সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো আস্থা। যদি সাধারণ বিনিয়োগকারীরা মনে করেন, তাঁদের সঞ্চয় নিরাপদ নয়, তবে তাঁরা পুঁজিবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। এর ফলে ব্যাংক খাতের উপর চাপ আরও বাড়বে এবং দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হবে।

আস্থা হারালে বিনিয়োগের পরিবেশ ভেঙে পড়ে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও তখন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাই একীভূতকরণের প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা কেবল মানবিক দায়িত্বই নয়, বরং অর্থনৈতিক প্রয়োজনও বটে।

সম্প্রতি অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়ছে। এক প্রবীণ বিনিয়োগকারী বলেন, “আমরা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে শেয়ার কিনেছি। যদি একীভূতকরণের নামে আমাদের টাকাই হারিয়ে যায়, তবে সাধারণ মানুষ কাকে ভরসা করবে?”

এই ক্ষোভ শুধু একজনের নয়; এটি হাজারো মানুষের বুকফাটা আর্তি। সামাজিক মাধ্যম ও বিনিয়োগকারীদের সংগঠনগুলোতেও একই প্রশ্ন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে—সরকার কি আমাদের সুরক্ষা দেবে, নাকি আমাদের ত্যাগের বিনিময়ে খাত সংস্কার হবে?

বর্তমান সময়ে দেশ এক অভূতপূর্ব রূপান্তরের পথে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের প্রতি জনগণের আস্থা ক্রমেই বাড়ছে। কারণ তিনি সর্বদা ন্যায়, সততা ও মানবিকতার পক্ষে কথা বলেন। তাই বিনিয়োগকারীরা বিশ্বাস করেন—প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি নিশ্চয়ই তাঁদের স্বার্থ রক্ষায় পদক্ষেপ নেবেন।

এই মুহূর্তে বিনিয়োগকারীদের আকুল আবেদন—একীভূতকরণের আগে তাঁদের পুঁজির সঠিক মূল্যায়ন ও ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা হোক। এটি কেবল অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন নয়, মানবিক দায়িত্বও বটে।

কীভাবে ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা যেতে পারে?

১. ন্যায্য মূল্যায়ন: একীভূত হওয়া ব্যাংকগুলোর শেয়ারের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ মূল্য নির্ধারণ করে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ন্যায্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা।

২. স্বচ্ছ প্রক্রিয়া: একীভূতকরণের প্রতিটি ধাপ জনগণের কাছে উন্মুক্ত রাখা, যাতে আস্থা তৈরি হয়।

৩. সরকারি গ্যারান্টি: বিনিয়োগকারীদের সঞ্চয় ফেরত দেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ তহবিল বা গ্যারান্টি তৈরি করা।

৪. আলোচনা ও সংলাপ: বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধি, ব্যাংক মালিক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা স্থাপন।

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের সংস্কার সময়ের দাবি। তবে এই সংস্কারের বোঝা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাঁধে চাপানো যায় না। তাঁদের রক্ত-ঘামে গড়ে তোলা সঞ্চয় ও বিনিয়োগের প্রতি অবিচার করা হলে সেটি হবে জাতির প্রতি অবিচার।

তাই এই মুহূর্তে প্রধান উপদেষ্টার কাছে আকুল আবেদন—একীভূতকরণের আগে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করুন। ন্যায় ও মানবিকতার ভিত্তিতেই গড়ে উঠুক নতুন আর্থিক খাতের ভিত্তি।

কারণ শেষ পর্যন্ত অর্থনীতির আসল শক্তি সংখ্যার অঙ্কে নয়, মানুষের আস্থায়। আর সেই আস্থাই হবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নতির মূল ভিত্তি।


Leave Your Comments




ব্যাংক-বীমা এর আরও খবর