প্রকাশিত : ১৯:০৭
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১৯:১৬
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতা আমাদের একটি দুঃখজনক সত্যের সামনে দাঁড় করিয়েছে—পুঁজিবাজার ক্রমশ ভঙ্গুর হয়ে উঠছে। একদিকে সরকার উন্নয়নের মিছিলে ব্যস্ত, অন্যদিকে দেশের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রতিদিন পুঁজিবাজারে ক্ষতির বোঝা বয়ে চলেছেন। এই বৈপরীত্য কেবল অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক ও নৈতিক সংকটেরও প্রতিচ্ছবি।
আজকের বাজারের চিত্রই যেন চোখে আঙুল দিয়ে এই সত্যকে দেখিয়ে দিচ্ছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৬৮ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৫৩৮১.৮৫-এ, যা প্রায় ১.২৫% পতন। একইভাবে ডিএসইএস ১৯.২৪ পয়েন্ট এবং ডিএস৩০ সূচক ২৩.৭০ পয়েন্ট কমেছে। বাজারে ১৮৩,২০৫টি লেনদেন সম্পন্ন হলেও ৩৮টি শেয়ারের দাম বাড়ার বিপরীতে ৩০৬টির দাম কমেছে এবং ৪৯টি অপরিবর্তিত থেকেছে।
অর্থাৎ স্পষ্টতই—পুরো বাজার লাল পতনের রক্তাক্ত চিত্রে ঢাকা।
অর্থ উপদেষ্টার চোখে এই বাস্তবতা অদৃশ্য কেন?
অর্থ উপদেষ্টা ও নীতিনির্ধারক মহল হয়তো বাজারের এমন অস্থিরতাকে ‘সাময়িক সমস্যা’ হিসেবে দেখেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—এটি সাময়িকই বা কতদিন? গত এক দশক ধরে পুঁজিবাজার নানা সময়ে ধ্বসের শিকার হয়েছে। প্রতিবারই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা সর্বস্বান্ত হয়েছেন। অথচ কার্যকর কোনো সংস্কার বা সুরক্ষামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
যদি দেশের অর্থনীতিকে সত্যিকার অর্থে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে হয়, তবে পুঁজিবাজারকে অবহেলা করা মানে মেরুদণ্ডকে দুর্বল রাখা। আর এই অবহেলার মাশুল গুনছেন লাখো বিনিয়োগকারী পরিবার।
রাশেদ মাকসুদকে চেয়ারম্যান করার যৌক্তিকতা কোথায়?
সবচেয়ে বড় উদ্বেগের জায়গা হলো—বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসই)-এর নেতৃত্বে অযোগ্য ব্যক্তিদের বসানো। জনাব রাশেদ মাকসুদকে বিএসইর চেয়ারম্যান করা হয়েছে, অথচ তিনি পুঁজিবাজার সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতা বা প্রজ্ঞা রাখেন না।
প্রশ্ন উঠছে—যেখানে অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ, দক্ষ পুঁজিবাজার বিশ্লেষক কিংবা বাজার-সচেতন নীতিনির্ধারকরা আছেন, সেখানে অযোগ্য ব্যক্তিকে কেন এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হলো? পুঁজিবাজার কোনো পরীক্ষাগার নয়, যেখানে অযোগ্য লোককে বসিয়ে বিনিয়োগকারীদের ভাগ্য নিয়ে খেলা করা হবে।
ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীর ক্ষতিপূরণ কে দেবে?
আজকের বাজারে যাদের শেয়ারের দর ভেঙে পড়েছে, তারা অনেকেই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। কেউ চাকরিজীবী, কেউ দিনমজুর, কেউ বা ছোট ব্যবসায়ী—যারা সঞ্চয় থেকে পুঁজিবাজারে টাকা ঢেলেছিলেন। তাদের স্বপ্ন ছিল সামান্য আয় থেকে কিছুটা লাভ তুলে সন্তানদের পড়াশোনা, বাড়িভাড়া কিংবা ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করা।
কিন্তু বাস্তবতা হলো—তাদের মূলধনই উবে যাচ্ছে। একদিকে ব্যাংক খাতে সুদের হার অস্থির, অন্যদিকে পুঁজিবাজারে টাকার ক্ষয়ক্ষতি—তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে? রাষ্ট্র কি তাদের প্রতি কোনো দায়িত্ব বহন করে না?
সমস্যার গভীরে যা লুকিয়ে আছে:
১. দুর্বল নেতৃত্ব ও অদক্ষ নিয়োগ: অভিজ্ঞতার বদলে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ।
২. কারসাজি ও ইনসাইডার ট্রেডিং: প্রভাবশালী মহলের হাতে বাজার পরিচালিত।
৩. স্বচ্ছতার অভাব: বিনিয়োগকারীর স্বার্থ রক্ষার নীতিমালা দুর্বল।
৪. নীতিনির্ধারকদের উদাসীনতা: অর্থ উপদেষ্টা ও কমিশনের দায়িত্বজ্ঞানহীন নীরবতা।
সমাধানের দিকনির্দেশনা:
১. যোগ্য নেতৃত্ব নিশ্চিতকরণ: বিএসই ও ডিএসইর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে বাজারজ্ঞানসম্পন্ন ও প্রমাণিত দক্ষ ব্যক্তিদের বসাতে হবে।
২. কঠোর শৃঙ্খলা আরোপ: কারসাজি, ইনসাইডার ট্রেডিং ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর অনিয়ম কঠোরভাবে দমন করতে হবে।
৩. বিনিয়োগকারীর সুরক্ষা তহবিল: ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠন করতে হবে, যাতে বাজার ধ্বসের সময় তারা সর্বস্বান্ত না হন।
৪. স্বচ্ছ নীতি ও জবাবদিহি: প্রতিটি সিদ্ধান্তের পেছনে স্বচ্ছতা থাকতে হবে এবং দায়িত্বহীনতার জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
৫. দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা: শিল্প, অবকাঠামো ও উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে পুঁজিবাজারকে প্রকৃত অর্থে অর্থনীতির প্রতিফলন করতে হবে।
আজকের বাজারের পতন কেবল একটি সংখ্যার খেলা নয়—এটি লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ত-ঘামে গড়া সঞ্চয়ের ধ্বংসযজ্ঞ। অথচ আমাদের নীতিনির্ধারকরা নীরব দর্শক।
প্রশ্ন রয়ে যায়—অর্থ উপদেষ্টা কি চোখে দেখেন না? তিনি কি জানেন না, পুঁজিবাজারের এই অস্থিরতা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে দুর্বল করছে? আর যদি জানেন, তবে পদক্ষেপহীনতার এই নীরবতা কেন?
জনগণের আস্থা হারিয়ে গেলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। এখনই সময়, দায়িত্বশীল নেতৃত্ব ও কার্যকর পদক্ষেপের। না হলে আগামী দিনের ইতিহাসে আজকের এই নীরবতা একদিন অভিশাপ হয়ে লেখা থাকবে।