প্রকাশিত : ১০:৩৯
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৪৮
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে আবারও নেমে এসেছে গভীর অন্ধকার। একদিনের লেনদেন শেষে সংখ্যার ঠাণ্ডা পরিসংখ্যানগুলো নিছক আর্থিক তথ্য নয়—বরং হাজারো বিনিয়োগকারীর ভাঙা স্বপ্ন, নষ্ট আস্থা আর বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাসের প্রতিধ্বনি।
দিনশেষে ডিএসইএক্স (DSEX) সূচক হারিয়েছে ৬৮.০৮ পয়েন্ট, পতনের হার দাঁড়িয়েছে ১.২৫%। একইভাবে ডিএসইএস (DSES) কমেছে ১৯.২৪ পয়েন্ট বা ১.৬৩%, আর ডিএস৩০ (DS30) সূচক নেমেছে ২৩.৭০ পয়েন্ট, যা পতনের হার ১.১২%। সংখ্যাগুলো নিস্তরঙ্গ হলেও এর ভেতরে জমে আছে হাজারো বিনিয়োগকারীর আর্তনাদ।
আজ লেনদেন হয়েছে মোট ১৮৩,২০৫টি ট্রেড, যার মাধ্যমে হাতবদল হয়েছে ২০.৬৪ কোটি শেয়ার এবং লেনদেনমূল্য দাঁড়িয়েছে ৬২১.৪৯ কোটি টাকা। এত বিপুল লেনদেনের ভিড়েও আশার আলো মেলেনি। ৩০৬টি কোম্পানি দর হারিয়েছে, মাত্র ৩৮টি কোম্পানি কিছুটা অগ্রগতি দেখাতে পেরেছে, আর ৪৯টি কোম্পানি অপরিবর্তিত থেকেছে।
দিনের শুরুটা ছিল আশাবাদের, সূচক উঠেছিল খানিকটা সবুজে। কিন্তু দুপুর গড়াতেই সূচক নামতে শুরু করে। দিনের শেষে গ্রাফ যেন পরিণত হলো বিনিয়োগকারীর ভাঙা মনের প্রতিচ্ছবিতে—প্রথমে ক্ষীণ আশা, পরে গভীর হতাশা।
আজকের বাজার বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে—
টেক্সটাইল খাতে কিছু শেয়ারের সামান্য উত্থান দেখা গেলেও সমগ্র খাত রক্ষা পায়নি।
বীমা খাতে লেনদেন কিছুটা সক্রিয় থাকলেও সামগ্রিক পতন ঠেকানো সম্ভব হয়নি।
ব্যাংক, ফার্মাসিউটিক্যালস, ইঞ্জিনিয়ারিং, পাওয়ার ও আইটি সেক্টরে স্পষ্ট দরপতন ঘটেছে।
মার্কেট ম্যাপে চোখ রাখলেই বোঝা যায়—প্রায় পুরো বাজার রক্তে রঞ্জিত। এক-আধটু সবুজ ব্লক চোখে পড়লেও তা যেন সমুদ্রের মাঝে বিন্দুর মতো তুচ্ছ।
আজকের এই পতন কেবল শেয়ারের দরপতন নয়—এটি একেকটি মধ্যবিত্ত পরিবারের নিঃশব্দ কান্না। কোথাও অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধের সঞ্চয়, কোথাও প্রবাসীর ঘামে-ভেজা উপার্জন, আবার কোথাও মায়ের জমানো টাকায় সন্তানের ভবিষ্যতের স্বপ্ন। প্রতিটি লাল গ্রাফের নিচে চাপা পড়ে আছে হাজারো মানুষের বেদনাভরা জীবনগাথা।
তাদের প্রশ্ন—কোথায় সেই প্রতিশ্রুতি? কোথায় সেই নিরাপদ বিনিয়োগের পরিবেশ? দেশের প্রবৃদ্ধির গল্প শোনা যায় প্রতিদিন, অথচ শেয়ারবাজারে কেন বারবার দেখা দেয় ধসের কালো ছায়া?
বিশেষজ্ঞদের মতে পতনের পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ—
১. তারল্য সংকট: ব্যাংক খাতে চাপ এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের উদাসীনতা বাজারকে দুর্বল করেছে।
২. নীতি-অস্পষ্টতা: নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যকর পদক্ষেপের অভাব বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে।
৩. বৈশ্বিক অর্থনীতির চাপ: ডলারের সংকট, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি একসাথে বাজারকে বিপর্যস্ত করছে।
৪. অতিরিক্ত জল্পনা-কল্পনা: কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ানো ও হঠাৎ দরপতন বিনিয়োগকারীদের মনে নতুন ভয়ের জন্ম দিচ্ছে।
তবে সবকিছু হতাশার নয়। ইতিহাস সাক্ষী—প্রতিটি পতনের পরই বাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যারা আস্থায় টিকে থেকেছেন, তারাই পরবর্তীতে লাভবান হয়েছেন।
এখনই প্রয়োজন—
শেয়ারবাজারে সংস্কার, যাতে স্বচ্ছতা ফিরে আসে।
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করা।
বিনিয়োগকারীর আস্থা ফিরিয়ে আনতে নীতিনির্ধারকদের দৃঢ় অবস্থান।
সতর্কবার্তা নাকি নতুন ভোর?
আজকের দিনটি প্রমাণ করেছে—শেয়ারবাজার শুধু সংখ্যার খেলাঘর নয়, এটি দেশের অর্থনীতির স্পন্দন। প্রতিটি লালচে চার্ট, প্রতিটি দরপতন বিনিয়োগকারীর চোখের জলে ভেসে ওঠে।
যদি সত্যিই আমরা একটি শক্তিশালী অর্থনীতি গড়তে চাই, তবে শেয়ারবাজারকে অবহেলা করার অবকাশ নেই। এটি কোনো জুয়ার আসর নয়—এটি মানুষের ভবিষ্যৎ, জাতির উন্নয়নের মেরুদণ্ড।
আজকের পতন তাই কেবল একটি ধস নয়, বরং নীতি-নির্ধারকদের জন্য কঠিন সতর্কবার্তা। এই অস্থিরতাকে যদি সঠিকভাবে সামলানো যায়, তবে এর ভেতর থেকেই জন্ম নেবে এক নতুন ভোর—যে ভোরে বিনিয়োগকারীর মুখে আবার ফিরবে হাসি, আর শেয়ারবাজার দাঁড়াবে প্রকৃত অর্থে জাতির অর্থনীতির দৃঢ় ভিত হয়ে।