প্রকাশিত : ১৯:১৯
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
✍️ রেজুয়ান আহম্মেদ
পঁচিশে পা রাখা অতসীর জন্মদিনের সন্ধ্যাটা ছিল আলোয় ঝলমলে, হাসির কলতানে মুখরিত। ড্রইংরুমের মাঝখানে রাখা চকোলেট কেকের ওপর জ্বলছিল পঁচিশটি মোমবাতি—ঠিক যেন জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের প্রদীপ্ত সূচনা। বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের হাসিমুখের প্রতিচ্ছবিতে অতসী নিজেও প্রাণখোলা হাসিতে উচ্ছল ছিল। নতুন চাকরি, পদোন্নতি এবং আসন্ন পিএইচডি প্রোগ্রামের প্রস্তুতি—সব মিলিয়ে এই পঁচিশ বছর বয়স তার কাছে ছিল এক ‘সোনালি সময়’, যেখানে প্রতিটি সম্ভাবনার দ্বার তার জন্য উন্মুক্ত। সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত, এই সময়টা নিজেকে গড়ে তোলার, আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনের এবং জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো স্বাবলম্বীভাবে নেওয়ার। আধুনিক নারীরা এখন শুধু সংসার নয়, নিজেদের স্বপ্ন পূরণে অধিক মনোযোগী—অতসী ছিল সেই নতুন প্রজন্মেরই একজন।
উৎসবের আলো যখন ধীরে ধীরে ম্লান হতে শুরু করল, আর অতিথিরা একে একে বিদায় নিলেন, তখন ঘরের ভেতরের দৃশ্যপট পাল্টে গেল। আনন্দের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক দুশ্চিন্তার মেঘ অতসীর মা-বাবার চোখেমুখে স্পষ্ট হয়ে উঠল। সোফায় বসা বাবা চশমার ফাঁক দিয়ে অতসীর দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি ছুঁড়ে দেখছিলেন, আর মায়ের নীরব চাহনি—যা কোনো শব্দ ছাড়াই অনেক কিছু বলছিল। কেকের শেষ টুকরো মুখে দিয়ে অতসী যখন মায়ের দিকে তাকাল, মা তার হাত ধরে নরম গলায় বললেন,
“বিয়েটা তো এবার করতেই হবে, মা। বয়স তো কম হলো না, পঁচিশ!”
এই একটি বাক্যেই অতসীর মুখে কেকের টুকরোটা হঠাৎ তেতো হয়ে গেল। জন্মদিনের আনন্দ মিলিয়ে গেল এক নিমিষে। সে বুঝতে পারল, তার বাবা-মায়ের কাছে পঁচিশ বছর কেবল একটি সংখ্যা নয়, বরং এক অদৃশ্য ঘড়ির কাঁটা, যা টিকটিক করে তাদের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে চলেছে। তাদের মতে, এই বয়স পেরোলেই একটি মেয়ের জীবনের সবচেয়ে বড় সুযোগ যেন হাতছাড়া হয়ে যাবে। অতসীর পেশাগত সাফল্য, উচ্চশিক্ষা—এসবই তাদের চোখে কেবল ভালো পাত্র পাওয়ার যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যার মাধ্যমে সমাজের চোখে তারা তাদের দায়িত্ব পূর্ণ করতে পারবে। অতসী মনে মনে ভাবল, তার জন্য এই পঁচিশ নতুন দিগন্তের সূচনা, আর বাবা-মায়ের কাছে এটি একটি চূড়ান্ত সময়সীমা, যার মধ্যে জীবনের সবচেয়ে ‘বড়’ কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। তাদের এই বিপরীতমুখী দৃষ্টিভঙ্গিই গল্পের মূল সংঘাতের সূচনাবিন্দু।
পরের কয়েক দিন অতসীর জীবন যেন একটি নিরবচ্ছিন্ন নাটকে পরিণত হলো। সমাজের অদৃশ্য মঞ্চে সে হয়ে উঠল এক বিপন্ন পণ্য, যার বাজারদর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ কমছে। প্রতিটি সকাল শুরু হতো মায়ের ফিসফিসানি দিয়ে,
“অমুকের মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। ও তো তোর থেকে কত ছোট!”
দুপুরে মায়ের হোয়াটসঅ্যাপে ভেসে আসত ঘটকের পাঠানো যোগ্য পাত্রের ছবি ও বিবরণ। উচ্চতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, আর্থিক সচ্ছলতা—সবকিছুই নিখুঁতভাবে যাচাই করা হতো। এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে অতসীর মনে হতো নিজেকে বাজারজাত করা একটি পণ্য হিসেবে উপস্থাপিত হওয়ার মতো, যেখানে তার স্বপ্ন, স্বাধীনতা, নিজের ইচ্ছা—সবই গৌণ হয়ে গেছে।
সন্ধ্যায় বাবা অফিস থেকে ফিরলে তার মুখে ফুটে উঠত সেই একই দুশ্চিন্তার ছাপ।
“পঁচিশ পার হলে কি আর ভালো সম্বন্ধ পাওয়া যায়? লোকে কত কথা বলবে!”
প্রতিবেশীরাও কম যেত না। বাইরে বের হতেই তারা জিজ্ঞেস করত,
“কি ব্যাপার, অতসী, বিয়ের কি খবর?”
তাদের চোখে অতসীর পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত থাকা যেন এক অপরাধ, এক সামাজিক বিচ্যুতি।
অতসীর ভেতর ক্রমশ ক্ষোভ ও হতাশায় ভরে উঠছিল। সে তার ঘরের কোণে বসে প্রিয় সাহিত্যিকদের লেখা বইয়ে আশ্রয় খুঁজত। সেলিনা হোসেনের উপন্যাসের সেই স্বাধীনচেতা নারী চরিত্রগুলো মনে পড়ত, যারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। তসলিমা নাসরিনের সাহসী লেখাগুলোও মনে আসত, যা নারীদের তাদের নিজস্ব সত্তার প্রতি সচেতন হতে শিখিয়েছে। অতসী বুঝতে পারছিল, তার এই লড়াই কেবল তার একার নয়, এটি বাংলা সাহিত্যে চিরন্তনভাবে চিত্রিত আধুনিক নারীর লড়াই। সে নিজেকে এক ক্ষতিগ্রস্ত পণ্য হিসেবে অনুভব করছিল, যার মূল্য বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমে যাচ্ছে, এবং এই মানসিকতা তাকে আরও ক্ষুব্ধ করে তুলছিল।
এই চাপ তাকে স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করল। অতসীর কাছে স্বাধীনতা কেবল অবাধ চলাফেরা বা পুরুষের সমান বেতন পাওয়া নয়। স্বাধীনতা মানে নিজের শরীর ও স্বপ্নের ওপর পূর্ণ অধিকার। স্বাধীনতা মানে নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার অধিকার। এই স্বাধীনতা তাকে পেশাগত জীবনে আত্মনির্ভরশীল করে তুলেছে, যা তাকে অন্যের ওপর নির্ভর না করে নিজের জীবন নিজের মতো করে পরিচালনা করার সুযোগ দেয়।
অতসী তার মাকে বোঝাতে চেয়েছিল, সে নিজের স্বপ্নের কাছে পৌঁছানোর জন্য একটি পেশা তৈরি করেছে, এবং এই স্বপ্নের জন্য সে বিয়ে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত নয়। কিন্তু তার মা-বাবা তার যুক্তিটিকে কেবল এক আধুনিক মেয়ের কল্পনাপ্রসূত চিন্তা হিসেবেই দেখছিলেন। তাদের কাছে বিয়ের বাজারের বাস্তবতাই ছিল প্রধান।
অতসী ও তার বাবা-মায়ের সম্পর্ক ক্রমশ এক সূক্ষ্ম অথচ গভীর সংঘাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। কথোপকথনে স্নেহ থাকলেও ভিতরে চাপা হতাশা ও ক্রোধ লুকিয়ে ছিল। বাবা-মায়ের প্রতিটি যুক্তি ছিল তাদের প্রজন্মের অভিজ্ঞতা এবং সমাজের চিরাচরিত মূল্যবোধের প্রতিফলন। তারা অতসীর ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। মা বলতেন,
“সব মেয়েরই তো একটি সংসার হয়। বয়স বাড়লে সন্তান ধারণে সমস্যা হয়, জানিস না?”
বাবা যোগ করতেন,
“সমাজে তো আর ভালো চোখে দেখবে না, মা। লোকে কত কথা বলবে! বুড়ো বয়সে বিয়ে, এর চেয়ে বড় কলঙ্ক আর কী?”
অতসী বুঝতে পারত, তাদের দুশ্চিন্তার কারণ কেবল সমাজের চাপ নয়, বরং বাংলাদেশের পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তনও এর পেছনে বড় ভূমিকা রাখে। যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবারে পরিণত হওয়ায় তারা নিজেদেরকে একা মনে করতেন। অতসীর মতো একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের দায়িত্ব তাদের কাছে এক বিশাল বোঝা মনে হতো।
এই সময় অতসী তার মা-বাবাকে একটি গল্প শোনাল। কলেজ জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিতুর গল্প। মিতু মেধাবী এবং উচ্চশিক্ষা নিয়ে ভালো চাকরির স্বপ্ন দেখত, কিন্তু পঁচিশের আগে বিয়ে দেওয়ার চাপ ছিল। অনার্স পরীক্ষার এক মাস আগে মিতু বিয়ে করানো হয়। এরপর দুটি সন্তানের মা হয়ে তার শরীর ও মন এতটাই বিধ্বস্ত হয়ে যায় যে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগই পায়নি। শ্বশুরবাড়ি কোনো সহযোগিতা দেয়নি, তাই চাকরির স্বপ্নও বিসর্জন দিতে হয়েছিল। অতসী বোঝাল, মিতুর জীবন কেবল একটি ট্র্যাজেডি নয়, এটি সেই সব নারীর গল্প, যারা সময়মতো প্রস্তুতি ছাড়া বিয়ে করে স্বপ্ন বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়।
অতসী বোঝাতে চেয়েছিল, বিয়ে সামাজিক প্রথা বা জৈবিক প্রয়োজন নয়, এটি একটি ঐচ্ছিক প্রয়োজন, যা সঠিক সময়ে অনুভূত হওয়া উচিত। মায়ের দিকে তাকিয়ে সে বলল,
“মা, রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তী বা হাসান আজিজুল হকের আগুনপাখির সেই নারীর মতো আমিও নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে চাই। আমি কোনো ক্ষতি চাই না। শুধু আমার জীবনকে আমার মতো সাজাতে চাই, যা আমাকে সুখী করবে।”
পারিবারিক সংঘাতের এই দোলাচলের মাঝেই অর্পণের আগমন ঘটে। অর্পণ প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধারণার বাইরে একজন ব্যতিক্রমী চরিত্র। অতসীর পেশা, স্বপ্ন ও স্বাধীনচেতা মানসিকতা তার কাছে অর্পণের শ্রদ্ধার কারণ।
এক সন্ধ্যায় অতসী অর্পণকে বাবা-মায়ের সঙ্গে পরিচয় করায়। তারা অবাক হয়ে দেখল, অর্পণ অতসীর পেশাগত সাফল্য নিয়ে উচ্ছ্বসিত, তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় আগ্রহী এবং স্বাধীনতাকে সম্মান জানায়। অতসী স্পষ্ট করল, তারা যাকে বিয়ে বলে চাপ দিচ্ছেন, তা তার কাছে কেবল একটি সামাজিক প্রথা। বিয়ে তার কাছে পবিত্র চুক্তি, পারস্পরিক সম্মান ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা।
অতসী বোঝাল, সে বিয়েকে অস্বীকার করছে না, বরং সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করছে।
“আমি আমার স্বপ্নের কথা বলেছি, আমার ইচ্ছার কথা বলেছি। আমি বিয়ে করতে চাই, তবে মনের বিরুদ্ধে নয়। অর্পণ আমাকে একজন মানুষ হিসেবে দেখে, আমার স্বপ্নকে সম্মান করে। আপনারা কি চান না যে আমার এমন একজন সঙ্গী হোক?”
অর্পণ এবং অতসীর সম্পর্ক আধুনিক সমাজের নতুন পারিবারিক মডেল হিসেবে প্রতিভাত হলো—যা দায়িত্ব নয়, বরং ভালোবাসা ও সম্মানের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
অতসীর বাবা-মা হয়তো রাতারাতি পুরোপুরি পরিবর্তিত হননি, কিন্তু তাদের মনে একটি পরিবর্তন এলো। তারা বুঝতে পারলেন, তাদের ভয় ও চাপ মেয়ের সুখের কারণ হতে পারে না। সংঘাত নতুন বোঝাপড়ায় রূপান্তরিত হলো, যা সন্তানের স্বাধীনতাকে সম্মান জানানোর দিকে এগিয়েছে।
অতসী তার ঘরের জানালার পাশে বসে নতুন ভোরের আলো দেখছিল। তার মনে হলো, জীবন তার নিজের হাতে এবং পথ সে নিজেই বেছে নেবে। লড়াই শেষ হয়নি, তবে এখন তার হাতে আছে তার জীবন, তার স্বপ্ন। নতুন ভোরের আলো উজ্জ্বল—যা তার স্বাধীনতার প্রতীক। গল্প শেষ হয়নি, এটি কেবল এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।