প্রকাশিত : ১৬:৪২
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
✍️ রেজুয়ান আহম্মেদ
ঘুষ! ফারসি ভাষায় শব্দটি নাকি এসেছে ‘কান’ থেকে—অর্থাৎ কানে কানে ফিসফিস করে দেওয়া টাকা। আর এই কান-ঘুষা যখন প্রকাশ্যে মুষ্টিবদ্ধ হাতে দেওয়া–নেওয়া হয়, তখন কি তাকে আমরা ‘ঘুষি’ বলি? বাংলা ভাষায় শব্দ দুটি যেন সহোদর; একটি ঘুষ–বাণিজ্যকে সূক্ষ্ম, অদৃশ্য ও শৈল্পিক রূপ দেয়, আর অন্যটি তার স্থূল, পেশীবহুল প্রকাশ। তবে আজকাল আর ফিসফিসানি নেই—হাত ও কানের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচে গেছে। এই লেনদেন এখন এক উন্মুক্ত কর্মযজ্ঞ, যা আধুনিক রাষ্ট্রের অদৃশ্য ভিত্তি। এই অদৃশ্য লেনদেনই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখে, আর যারা এতে অংশ নেয় না, তাদের জীবন স্থবির হয়ে পড়ে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে ঘুষের এই কারবার কেবল একতরফা হয়রানির গল্প নয়; এটি একটি জটিল সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। এখানে ঘুষ কেবল অসহায় নাগরিকের পকেট থেকে ছিনিয়ে নেওয়া অর্থ নয়, বরং সেই নাগরিকেরই এক ধরনের “স্বেচ্ছাপ্রণোদিত” বিনিয়োগ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটি জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৯.৭৬ শতাংশ নাগরিক স্বেচ্ছায় ঘুষ দেন, কারণ তারা বুঝে গেছেন—দ্রুত সেবা পেতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই। এই প্রবণতা শহরে গ্রামীণ অঞ্চলের তুলনায় সামান্য বেশি; নগরবাসীর ৯.৭৯ শতাংশ স্বেচ্ছায় ঘুষ দেন। এখানেই এক গভীর সামাজিক বাস্তবতা ফুটে ওঠে: ঘুষ দেওয়া আর নৈতিক পরাজয় নয়, বরং এক বাস্তবসম্মত ও বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল।
উচ্চবিত্তরা তুলনামূলকভাবে বেশি ঘুষ দেন, কারণ তারা মূলত টাকা দিয়ে সেবা কিনে নিতে চান। এই দৃশ্যমানতা বা ‘ভিজিবিলিটি’ এক ধরনের অদৃশ্য ফাঁদ, যা সেবাগ্রহীতাকে মনে করায়—অফিস বা প্রতিষ্ঠানটি মানসম্মত কর্মপরিবেশে চলছে। কিন্তু এই দৃশ্যমানতার আড়ালেই লুকিয়ে থাকে অদৃশ্য লেনদেনের বিশাল জগৎ। জনগণ এখন বুঝে গেছে, অর্থ খরচ না করলে কাজ হবে না—হলেও তা বিলম্বিত হবে। এই উপলব্ধি থেকে জন্ম নিয়েছে এক নতুন সামাজিক চুক্তি: কাজ পেতে হলে ‘সংশ্লিষ্টদের খুশি’ করতেই হবে। তাই এই গল্প কেবল একজন নাগরিকের অসহায়ত্বের নয়, বরং সমান্তরাল রাষ্ট্রব্যবস্থার অদৃশ্য কার্যপ্রণালীর এক সরস উপাখ্যান।
বিআরটিএ-এর মহাজাগতিক যাত্রা
হাবিবুর রহমান সাহেব, একজন মধ্যবয়সী নীতিপরায়ণ ব্যক্তি। বহু বছর ধরে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য চেষ্টা করছেন, কিন্তু কাজটি কোনোভাবেই হচ্ছে না। সরকারি অফিসের নিয়মনিষ্ঠার প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা। অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে সাইনবোর্ডের লেখা পড়লেন—“ডিজিটাল বাংলাদেশ, জনগণের সেবায় নিবেদিত” ইত্যাদি। তিনি হাসলেন। মনে পড়ল মিশেল ফুকো নামের এক পশ্চিমা তাত্ত্বিকের উক্তি—“দৃশ্যমানতাই একটি ফাঁদ।” বাইরের পরিবেশ যত পরিপাটি, ভেতরের কর্মকাণ্ড ততটাই ঘোলাটে।
ভেতরে গিয়ে তিনি ফাইল জমা দিলেন। কর্মচারী ওয়াদুদ, যিনি লাইসেন্সধারীদের ছবি তোলার কাজেও নিয়োজিত, ফাইল হাতে নিয়ে বললেন, “স্যার, ফরমে ভুল আছে। রিজেক্ট।” হাবিবুর সাহেব হতাশ হলেন। কোনো নির্দেশনা না দিয়ে ওয়াদুদ কেবল কৌশলে সংশোধনের ইঙ্গিত দিলেন। কিছুক্ষণ পর এক দালাল, আতিক, এগিয়ে এল। নিজেকে কর্মচারীর “নিকটতম বড় ভাই” দাবি করে আশ্বাস দিলেন, লাইসেন্স পেতে কোনো ঝামেলা হবে না। অফিসের প্রতিটি ইঞ্চি তাঁর চেনা, প্রতিটি নিয়ম তাঁর নখদর্পণে। তিনি ভেতরের অদৃশ্য প্রক্রিয়া ও নিয়মাবলী সব জানেন।
আতিকের কাছেই হাবিবুর সাহেব জানলেন, সরকারের জরিপ অনুযায়ী বিআরটিএ-তে সেবা নিতে আসা নাগরিকদের ৬৩.২৯ শতাংশই ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছেন। আতিকের ভাষায়, “এটাই আমাদের সাফল্যের স্বীকৃতি। আমরাই সরকারি সেবায় ঘুষের শীর্ষে, যা প্রমাণ করে আমাদের দক্ষতা ও কাজের গতি।”
তিনি ব্যাখ্যা করলেন, “অফিস চলে অদৃশ্য মূল্যতালিকা মেনে। পেশাদার লাইসেন্সের জন্য সরকারি ফি ছাড়াও দিতে হয় ২,২০০ টাকা ঘুষ। নিরক্ষর হলে খরচ আরও ৩০০ টাকা বেশি। এটা শুধু ঘুষ নয়, স্যার, বরং এক ধরনের ‘এক্সপ্রেস সার্ভিস চার্জ’। টাকা না দিলে ফাইল কেউ ছুঁয়েও দেখে না।”
আতিক জানালেন, ঘুষের টাকা এডি (সহকারী পরিচালক) ও ইন্সপেক্টরদের হাতে পৌঁছায়। লক্ষ্মীপুর বিআরটিএ অফিসের মতো আরও অনেক জায়গায় দালাল চক্রের মাধ্যমে এই লেনদেন চলে। দুদকের অভিযান চালিয়েও শরীয়তপুর অফিসে দালালদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা যায়নি; তারা মোটরযান পরিদর্শকের ছত্রচ্ছায়ায় কাজ করে। দালালরা এখন আর বিচ্ছিন্ন অপরাধী নয়, বরং এই সিস্টেমের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একজন ধরা পড়লে আরেকজন আসে—চাহিদা ও সরবরাহ এই চক্রকে সচল রাখে।
এই ব্যবস্থা এতটাই সুগঠিত যে ঘুষ না দিলে দিনের পর দিন ঘুরতে হয়, কিন্তু অতিরিক্ত টাকা দিলেই মাসের মধ্যে লাইসেন্স পাওয়া যায়। কর্মচারীদের কাছে ঘুষ একপ্রকার ‘উপরি রোজগার’।
পাসপোর্ট অফিসের স্বর্গের টিকিট
ড্রাইভিং লাইসেন্সের কাজ শেষ করে এবার হাবিবুর সাহেব গেলেন পাসপোর্ট অফিসে। তাঁর পাসপোর্টে নামের বানানে একটি ছোট ভুল, যা সংশোধন জরুরি। কিন্তু এখানে এসে তিনি দেখলেন ভিন্ন এক চিত্র। এখানে ঘুষ কেবল দালালের হাতে সীমাবদ্ধ নয়; বরং একটি “গণতান্ত্রিক” ব্যবস্থার মতো পুরো অফিসজুড়ে ছড়িয়ে আছে। দারোয়ান থেকে আনসার, সহকারী পরিচালক—সকলেই সিন্ডিকেটের অংশ। ঘুষ নেওয়া এখানে অপরাধ নয়, বরং সবার অংশগ্রহণে এক সম্মিলিত উৎসব।
হাবিবুর সাহেব জানলেন, নাম সংশোধনের জন্য ঘুষ লাগে ৩০–৩২ হাজার টাকা, আর জন্ম তারিখ বদলাতে হলে ৫০ হাজার পর্যন্ত। একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রতি মাসে শুধু রোহিঙ্গা ও ভারতীয় নাগরিকদের পাসপোর্ট প্রদানের মাধ্যমে এই সিন্ডিকেট ১০–১৫ কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য করে। প্রতিটি আঞ্চলিক অফিসের রয়েছে নিজস্ব সিন্ডিকেট—যা প্রমাণ করে, প্রক্রিয়াটি কতটা প্রাতিষ্ঠানিক।
বরগুনা অফিসের সহকারী পরিচালক নিয়মিত আসেন না। এক সেবাপ্রার্থী জানতে চাইলে তিনি অসুস্থতার কথা বলেন। কিন্তু বাস্তবে এটি এক পরিকল্পিত কৌশল—কৃত্রিম জট তৈরি করে নাগরিককে দালালের কাছে ঠেলে দেওয়া। দালালই অসুস্থ কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে ফাইল পার করে দেয়।
ক্ষমতার স্তরবিন্যাস এখানে পদমর্যাদার ওপর নয়, বরং এই অদৃশ্য ঘুষব্যবস্থায় কার অবস্থান কতটা শক্তিশালী, তার ওপর নির্ভর করে। একজন পিয়নও ফাইল আটকে রেখে সিনিয়র কর্মকর্তার চেয়েও প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারে। ফলে সরকারি কর্মচারী আচরণবিধি ১৯৭৯-এর কোনো ধারা কার্যকর থাকে না।
ভূমি অফিসের ভূমিদাস
এবার হাবিবুর সাহেব গেলেন জমির নামজারি করতে। এখানে ঘুষের সংস্কৃতি আরও পুরনো—প্রায় মধ্যযুগীয় ভূমিদাস প্রথার মতো। সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের প্রতিটি স্তরেই ঘুষ আবশ্যক। নির্ধারিত ফি-এর পাঁচ থেকে সাত গুণ বেশি টাকা দিতে হয় নামজারির জন্য।
একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাব-রেজিস্ট্রার দলিল মূল্যের ১% অগ্রিম ছাড়া কোনো দলিল করে না। সেরেস্তা ফি বাবদ দলিলপ্রতি নেয় ২,০০০ টাকা। হেবা ঘোষণায় প্রতি শতাংশে ৩০০ টাকা, বিনিময় দলিলে ৫০০ টাকা, আর উচ্চমূল্যের দলিলে ২০–৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়া হয়। নকলের জন্য আলাদা ১,৫০০ টাকা।
এইসব টাকা আদায় করেন সহকারী ও পিয়নরা। পিয়ন ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায় করে এবং না দিলে দলিল রেজিস্ট্রি বন্ধ করে দেয়। অথচ ভূমি অফিসের আসল দায়িত্ব—ভূমি জোনিং, রেকর্ড হালনাগাদ ও খাস জমি ব্যবস্থাপনা। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে এসব নিয়ম অর্থহীন, কারণ তারা জানে কাজ আদায় করতে হলে অদৃশ্য মূল্যতালিকাই মানতে হবে।
এখানে ঘুষ কেবল লেনদেন নয়, বরং ক্ষমতা ও আধিপত্যের প্রতীক, যেখানে সাধারণ মানুষ একজন ‘ভূমিদাস’ হয়ে নিজের অধিকার ফিরে পেতে তথাকথিত প্রভুদের খুশি করতে বাধ্য।
ঘুষের বিশ্বজনীনতা
হাবিবুর সাহেব উপলব্ধি করলেন, ঘুষ কেবল বিআরটিএ, পাসপোর্ট বা ভূমি অফিসে সীমাবদ্ধ নয়; সমাজের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি সরকারি দপ্তরে এটি ছড়িয়ে আছে। যেন এক অদৃশ্য মাকড়সার জাল, যেখানে প্রতিটি সুতো একে অপরের সাথে সংযুক্ত।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘুষ লেনদেনে দ্বিতীয় অবস্থানে। এক অধ্যাপক তাঁর মেয়ের পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের জন্য পুলিশের হাতে নগদ নয়, ডিজিটাল মাধ্যমে টাকা দেন—যা অপরাধের অকাট্য প্রমাণ রেখে যায়। অর্থাৎ ঘুষ এখন প্রযুক্তির সাথেও তাল মিলিয়ে চলছে। তবে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে মানুষ আদালত বা পুলিশের বদলে জনপ্রতিনিধি, ধর্মীয় নেতা বা পারিবারিক সালিশের মতো অনানুষ্ঠানিক পথেই ভরসা রাখে—যা বিচার ব্যবস্থার প্রতি গভীর অনাস্থা নির্দেশ করে।
বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বা লোড বাড়ানোও দুর্নীতিমুক্ত নয়। তিতাস গ্যাসের এক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ—প্রধানমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে ঘুষের বিনিময়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সংযোগ দিয়েছেন। প্রতিটি সংযোগে ৩–৫ কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমতি এড়াতে ১০ মেগাওয়াটকে একাধিক ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে।
এগুলো প্রমাণ করে, ঘুষ এখন কেবল ছোটখাটো কাজ নয়, বরং বৃহৎ অবকাঠামো ও শিল্পায়নেরও নেপথ্য চালিকা শক্তি।
অদৃশ্য মানদণ্ড ও জীবনের রেন্ট-সিকিং
সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে প্রচলিত একটি শব্দ ‘উপরি রোজগার’। এটি ঘুষের সামাজিক উপাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীরাও এর বাইরে নন; পেনশনের টাকা তুলতে গেলেও ঘুষ দিতে হয়। অর্থাৎ, যিনি সারা জীবন রাষ্ট্রকে সেবা দিয়েছেন, তাকেও নিজের প্রাপ্য “ক্রয়” করতে হয় ঘুষ দিয়ে।
সবশেষে, হাবিবুর সাহেব হাতে নিলেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) ২০২৪ সালের দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই)। টিআইবি জানিয়েছে, এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ২০২৩ সালের ১০ম থেকে ২০২৪ সালে ১৪তম স্থানে উন্নীত হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে সুখবর মনে হলেও বাস্তবে দুর্নীতি বেড়েছে—২০২৩ সালে স্কোর ছিল ২৪, যা ২০২৪ সালে নেমে দাঁড়িয়েছে ২৩। অবস্থানের উন্নতি ঘটেছে শুধু অন্যান্য দেশের আরও খারাপ ফলাফলের কারণে। যেন প্রতিযোগিতা—কে কত ভালোভাবে ব্যর্থ হতে পারে।
এই সূচকের দৃশ্যমান কোনো প্রভাব জনগণের জীবনে পড়ে না। কয়েক দিনের জন্য মিডিয়ায় শোরগোল উঠলেও বাস্তবতা হলো—ঘুষ এখন সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিটি দপ্তর নিজস্ব নিয়মে চলে এই অদৃশ্য ব্যবস্থার ছায়ায়। এমনকি কত শতাংশ ঘুষ কোন কাজে দিতে হবে, তারও এক মোটামুটি মানদণ্ড গড়ে উঠেছে।