রেজুয়ান আহম্মেদআর্থিক সংকটে জীর্ণ এই পৃথিবীতে জীবনের গল্প বড়ই বিচিত্র। কোথাও জীবন পূর্ণতার হাসিতে ঝলমল করে ওঠে, আবার কোথাও তা করুণ পরিণতির দিকে ধেয়ে যায়। নন্দিনীর জীবন ছিল এমনই এক করুণ কাহিনীর প্রতিচ্ছবি। সে ছিল এক অভাগিনী। তার জীবনের কোনো উদ্দেশ্য ছিল না, ছিল কেবল বেঁচে থাকার এক নিরন্তর সংগ্রাম।
সেদিনের সন্ধ্যাটা ছিল বড়ই করুণ। আকাশের কান্না যেন থামতেই চাইছিল না। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো শহরের নোংরা রাস্তা ধুয়ে দিচ্ছিল, আর নন্দিনী নামের কিশোরীটি এক কোণে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। ভেতরের শূন্যতা আর বাইরের বৃষ্টি মিলে এক অদ্ভুত আঁধার তৈরি করেছিল। পেটের ভেতর যেন একটা ইঁদুর ক্রমাগত কুরে কুরে খাচ্ছিল, আর সেই যন্ত্রণা শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ছিল। শুকনো ঠোঁট, ভেতরে ঢোলা চোখ আর তার নিচের কালির গভীর ছাপ—সবই তার অভুক্ত থাকার সাক্ষ্য বহন করছিল। আশেপাশের মানুষজন ব্যস্তভাবে হেঁটে যাচ্ছিল, যেন তার অস্তিত্বটুকুও তাদের চোখে ধরা পড়ছিল না।
হঠাৎ এক ঝলক আলো চোখে পড়ে তার। একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক মোবাইল হাতে হেঁটে যাচ্ছিলেন। নন্দিনীর ভেতর থেকে অদ্ভুত এক সাহস উঁকি দিল—ক্ষুধা যেন সমস্ত জড়তা ভেঙে দিয়েছে। সে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে গিয়ে বলল—
“চাচা, একটু কিছু খেতে দেবেন?”
তার কণ্ঠ যেন ভাঙা বাঁশির মতো কাঁপছিল। ভদ্রলোক থমকে দাঁড়ালেন। চোখে এক ঝলক করুণা ফুটে উঠেছিল। কিন্তু ঠিক তখনই পেছন থেকে ভেসে এল এক রুক্ষ গলা—
“ভাই, এসব ভিখারিদের বিশ্বাস করবেন না! এরা প্রতারক! একবার টাকা দিলে আবার আসবে।”
ভদ্রলোকের চোখে সন্দেহের ছায়া নেমে এলো। তিনি দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল নন্দিনী। প্রতারক? সে তো কেবল খাবারের জন্য হাত পেতেছিল। তবে কি ক্ষুধার্ত হওয়াও প্রতারণা?
রাত গভীর হলো। নন্দিনী ফুটপাতের এক কোণে বসে পড়ল। মাথার ওপর টিনের চাল থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছিল। ভেতরের যন্ত্রণা আর হতাশা মিলে চোখ দিয়ে জল হয়ে ঝরছিল। এমন সময় এক মধ্যবয়সী নারী তার পাশে এসে দাঁড়াল। নোংরা শাড়ি পরা, চোখে এক কঠিন কাঠিন্যের ছাপ।
নন্দিনী চোখ মুছে ফিসফিস করে বলল, “খিদে পেয়েছে… দুদিন কিছু খাইনি।”
নারীটির গলা হঠাৎ নরম হলো, “চল, খেতে দিচ্ছি।”
ক্ষুধার্ত নন্দিনীর মনে হলো, যেন স্বর্গের দেবী এসে তাকে উদ্ধার করতে এসেছেন। সে চুপচাপ নারীর হাত ধরে হাঁটতে লাগল। কিন্তু কিছুদূর যেতেই মনে অদ্ভুত এক ভয় জাগল। নারীটি তাকে শহরের মূল রাস্তা ছেড়ে সরু, অন্ধকার গলির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। শেষ মাথায় কয়েকজন পুরুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছিল। চোখে তাদের অদ্ভুত লোভী দৃষ্টি।
নন্দিনীর বুক ধক করে উঠল। হাত ছাড়াতে চাইলে নারীটি শক্ত করে ধরে বলল—“তুই পালাতে পারবি না।”
সে বুঝল, ফাঁদে পড়েছে। চারদিকে শিকারিরা। ক্ষুধার্ত পেট, দুর্বল শরীর আর অসহায় চোখ যেন তাদের লোভ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এক পুরুষ কুৎসিত হাসি হেসে বলল, “এবার খেতে দেব, কেমন?”
নন্দিনী চোখ বিস্ফারিত করে তাকাল। বাঁচতে চাইলেও শরীরে শক্তি নেই। মনের শেষ আশাটুকুও নিভে গেল। সেই রাত তার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ রাত হয়ে রইল।
পরদিন সকালে জ্ঞান ফিরল নন্দিনীর। সে এক বদ্ধ ঘরে পড়ে আছে। শরীর জুড়ে অসহ্য ব্যথা। ঠিক তখনই দরজার ফাঁক দিয়ে এক চিলতে আলো এসে পড়ল। এটাই সুযোগ! শেষ শক্তি জোগাড় করে দরজা ঠেলে বেরিয়ে পড়ল। বাইরে কেউ নেই। সে পাগলের মতো দৌড়াতে লাগল।
অবশেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে একটি পুরোনো বাড়ির সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। দরজা খুলে বেরোলেন এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক।
“কে তুমি?” তার কণ্ঠে স্নেহ আর উদ্বেগ।
“আমাকে… সাহায্য করুন…”—নন্দিনী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল।
ভদ্রলোকের স্ত্রী, প্রাক্তন শিক্ষিকা শিউলি দেবী, তাকে ঘরে নিয়ে গেলেন। খাবার দিলেন, নতুন কাপড় দিলেন। এতদিন পর কেউ তাকে ভালোবাসার চোখে দেখছে—বিশ্বাস করতে পারছিল না নন্দিনী। তাদের নাম সমরেশ বাবু ও শিউলি দেবী। সন্তানহীন এই দম্পতির কাছে নন্দিনী নতুন আশ্রয় পেল।
কিন্তু কিছুদিন পরই শোনে—তাদের জমির ঝামেলা মেটাতে নন্দিনীকে প্রভাবশালী এক পরিবারের হাতে তুলে দিতে চাইছে তারা। নন্দিনী বুঝল, এই শহরে কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না। সে ঠিক করল, পালাতে হবে।
এক রাতে জানালার গ্রিল ভেঙে পালিয়ে গেল সে। এবার তার মনে ভয় যেমন আছে, তেমনি প্রতিশোধের আগুনও জ্বলে উঠেছে।
ভাঙা এক মন্দিরের বারান্দায় আশ্রয় নিল নন্দিনী। সেখানে তার মতো আরও অনেক শিশু দেখল। পরে পরিচয় হলো ফণীধর নামের এক বৃদ্ধের সঙ্গে। ফুটপাতে পুরোনো বই বিক্রি করতেন তিনি। মুখ রুক্ষ হলেও মনটা ছিল নরম। আশ্রয় দিলেন নন্দিনীকে, তবে শর্ত দিলেন—কাজ করতে হবে। কাগজ ভাঁজ, বই পরিষ্কার—সব করত সে। ফণীধর তাকে পড়ালেখা শেখালেন, শেখালেন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে বাঁচার কৌশল।
তার কাছেই জানল, শত শত শিশু পাচার হয়ে যায় রাতের অন্ধকারে। আর সেই চক্রের মূলেই আছে সেই নারী, যিনি প্রথম দিন তাকে প্রলুব্ধ করেছিলেন। নারীটি একসময় ছিল ভুক্তভোগী, পরে নিজেই শিকারি হয়ে গেছে।
প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে উঠল নন্দিনী। শুধু নিজের মুক্তি নয়, আরও অনেক নন্দিনীর মুক্তি চাই তার। দিনে কাজ, রাতে পড়াশোনা—শক্ত হয়ে ওঠে সে। জানতে পারে, এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এই চক্রের হোতা।
বছর কেটে যায়। দুর্বল কিশোরী নয়, সে এখন শিক্ষিত, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তরুণী। ফণীধরের মৃত্যুর পর তিনি রেখে যাওয়া ছোট লাইব্রেরি চালায় নন্দিনী। সেটিই হয়ে ওঠে অসহায় শিশুদের নিরাপদ আশ্রয়। আড়ালে নন্দিনী তথ্য সংগ্রহ শুরু করে পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে।
অবশেষে মুখোমুখি হয় সেই নারীর সঙ্গে। নন্দিনী বলল—“তুমি বলেছিলে, আমি পালাতে পারব না। কিন্তু আমি ফিরে এসেছি।” নারীটি অবাক হয়ে গেল। ভয়ের পাশাপাশি মনে হলো, নন্দিনীর দৃঢ়তায় একরকম গর্বও জন্ম নিল তার। সে নিজের ভুল স্বীকার করে চক্রের প্রধানের নাম ফাঁস করল।
পুলিশের সহায়তায় ধরা পড়ল সেই প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। ধ্বংস হলো এক অমানবিক চক্র।
এ জয় শুধু নন্দিনীর নয়—হাজারো অভাগা শিশুর জয়। ক্ষুধা যে আত্মাকে ভেঙে দেয়, সেটাই প্রতিশোধের আগুনে শক্তিতে রূপান্তরিত হলো।
শেষ দৃশ্যে নন্দিনী ফুটপাতের সেই সব শিশুদের পাশে গিয়ে বলল, “তোমরা কেউ একা নও।” সে শিখিয়ে দিল—ক্ষুধার মুক্তি শুধু খাবার নয়, জ্ঞান আর আত্মসম্মানেও লুকিয়ে আছে। অভাগিনী নন্দিনী আজ আর অভাগিনী নয়, সে এখন হাজারো শিশুর ভরসার প্রতীক।
Leave Your Comments