প্রকাশিত : ০৯:১৯
১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৯:২৩
১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সংগ্রাম দত্ত
শ্রীমঙ্গল বাংলাদেশের চায়ের রাজধানী হিসেবে খ্যাত, যেখানে সারি সারি সবুজ চা-বাগান মন মোহিত করে। এখানকার পাহাড়-টিলা, ঝরনা ও সবুজ প্রকৃতি পর্যটকদের জন্য স্বর্গরাজ্য।
চারিদিকে সবুজে ঘেরা চা বাগান, পাহাড়, বনাঞ্চল, হাওর , হ্রদ ইত্যাদি শ্রীমঙ্গলকে সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তোলে।
ঢাকা থেকে ১৮০ কিলোমিটার দূরে, মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার চিরহরিৎ সবুজ শহরটি কেবল চা-বাগানের জন্যই বিখ্যাত নয়। বরং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পর্যটন সম্ভাবনার জন্যও এটি এখন দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় গন্তব্য। শহরের পাশেই অবস্থিত রাধানগর গ্রাম, ছোট্ট হলেও পর্যটনের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে পরিবর্তিত একটি নতুন মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
প্রকৃতির কোলে রাধানগর
শ্রীমঙ্গল উপজেলা শহর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটারের দূরত্বে অবস্থিত রাধানগর গ্রাম। পাখির চোখে দেখা এই গ্রামের নান্দনিক সৌন্দর্য যেন এক শ্যামল সংরক্ষিত বনভূমি। লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক এবং চা-বাগানের প্রকৃতিক ছায়ায় গ্রামটি এক অনন্য পরিবেশ পেয়েছে। এখানে আধুনিক রিসোর্ট ও কটেজ গড়ে উঠেছে, যা পর্যটকদের শহুরে কোলাহল থেকে দূরে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ প্রদান করছে।
পর্যটনের ছোঁয়ায় বদলানো জীবন
একসময় কৃষিনির্ভর গ্রামটি আজ পর্যটনের মাধ্যমে নতুন অর্থনৈতিক দিগন্তে প্রবেশ করেছে। স্বাধীনতার পর এখানে আখচাষের প্রবর্তন হয়েছিল, পরবর্তীতে লেবু ও কাঁঠালের বাগান গ্রামটিকে সুগন্ধি সমৃদ্ধ ভূখণ্ডে রূপান্তরিত করে। ২০০৯-১০ সালের দিকে পর্যটনের সম্ভাবনা স্পষ্ট হতে থাকে। লাউয়াছড়া বন এবং চা-বাগানের মনোমুগ্ধকর পরিবেশে পর্যটকরা আগ্রহী হতে শুরু করেন, আর সেই সুযোগে রাধানগর গড়ে তোলে নতুন পর্যটনপরিচয়।
আজ রাধানগরের প্রতিদিন গড়ে অন্তত ৫ শতাধিক পর্যটক আসে। গ্রামের বিভিন্ন রিসোর্ট ও কটেজে রাতযাপন করে। এক গ্রামে বর্তমানে রয়েছে ৫০টিরও বেশি রিসোর্ট, কটেজ, হোটেল ও গেস্ট হাউস। দেশ-বিদেশ থেকে এখানে আসেন চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা।
পরিবেশবান্ধব পর্যটন ও স্থাপত্য
রাধানগরের রিসোর্টগুলো পরিবেশবান্ধব নকশার মাধ্যমে পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে। কাঠ ও বাঁশ ব্যবহার করে নির্মিত কটেজগুলো প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি হয়েছে। পর্যটকরা এখানে রাত কাটানোর সময় প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে যাওয়ার অভিজ্ঞতা পায়।
শান্তিবাড়ি রিসোর্টের পরিচালক তানভীর লিংকন আহমেদ জানান, “২০১২ সালে এই রিসোর্ট খোলার পর থেকে দেশের ও বিদেশের অসংখ্য প্রকৃতিপ্রেমিক পর্যটক এখানে আসছেন। এই পর্যটন শিল্প স্থানীয় কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করেছে।”
অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব
রাধানগরের পর্যটন শিল্প শুধু গ্রামের মানুষের জীবনধারাকে পরিবর্তন করেনি, বরং পুরো শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজার জেলার অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত খুলেছে। রেস্টুরেন্ট, গাইড, গাড়িচালক, হস্তশিল্পের ব্যবসায়ী – সবকটি ক্ষেত্রে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। চামুং রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড ইকো ক্যাফের পরিচালক তাপস দাশ জানান, “পর্যটকরা রিসোর্টে রাতযাপন, খাবার খাওয়া এবং ভ্রমণে অংশ নেয়, যা সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধিতেও সহায়ক হয়েছে।”
শ্রীমঙ্গলের পর্যটন কল্যাণ পরিষদের সদস্য সচিব তারেকুর রহমান পাপ্পু বলেন, “রাধানগর কমিউনিটি বেসড ট্যুরিজমের একটি উদাহরণ। এখানে স্থানীয় মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি ও নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে পর্যটন শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।”
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
শ্রীমঙ্গল প্রেস ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আফম আব্দুল হাই ডন বলেন, শ্রীমঙ্গলের পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত রাধানগর গ্রাম প্রকৃতির এক অপূর্ব উপহার। সবুজ বনভূমি, পাহাড়ি দৃশ্য এবং শান্ত পরিবেশের কারণে এটি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্র। স্থানীয় পর্যটন শিল্প কেবল অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে না, বরং গ্রামীণ মানুষের জীবিকাও নিশ্চিত করছে। আমরা আশা করি, সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও পরিবেশ সংরক্ষণের মাধ্যমে রাধানগর গ্রাম দেশের পর্যটন মানচিত্রে আরও আলো ছড়াবে।
শ্রীমঙ্গলের পর্যটন শিল্প বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইসলাম উদ্দিন জানিয়েছেন, “আমরা ইতোমধ্যেই রাধানগর এলাকায় রাত্রিকালীন সড়ক বাতির প্রকল্প গ্রহণ করেছি। সরকারি বরাদ্দ পেলে পর্যটন শিল্প আরও বিস্তৃত হবে এবং এলাকার অর্থনীতিতে বৃহৎ অবদান রাখবে।”
রাধানগর গ্রাম প্রমাণ করছে যে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পরিবেশবান্ধব পর্যটন এবং স্থানীয় উদ্যোগ একত্রিত হলে একটি সাধারণ গ্রামও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হতে পারে। চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গল থেকে শুরু করে এই ছোট্ট গ্রামটি হয়ে উঠেছে দেশের পর্যটন শিল্পের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।