প্রকাশিত : ১৭:১৩
০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১৭:১৮
০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন ধরেই সমালোচনার মুখে। দুর্বল পরিচালনা, খেলাপি ঋণ আর অনিয়ম তো আছেই; তার ওপর কিছু ব্যাংক লোকসানে থেকেও নিজেদের কর্মীদের মোটা অঙ্কের বোনাস দিয়ে আসছিল। অবশেষে সেই লাগাম টানল বাংলাদেশ ব্যাংক।
শনিবার রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ঘোষণা দেন, যেসব ব্যাংক লোকসানে থাকবে, সেই ব্যাংকের কর্মকর্তারা কোনো বোনাস পাবেন না। তিনি আরও জানান, যদি কোনো ব্যাংকের মূলধন ১০ শতাংশের নিচে নেমে যায় বা প্রভিশন লস হয়, তবে কোনো ডিভিডেন্ড বা বোনাস দেওয়া যাবে না। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক খাতকে স্থিতিশীল করার একটি সুস্পষ্ট বার্তা দিল।
গভর্নর স্বীকার করেন, অর্থনীতি পুরোপুরি স্থিতিশীল না হলেও আংশিক সাফল্য এসেছে। হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার কমেছে এবং প্রবাসী আয় নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এছাড়া, অর্থ পাচারের জন্য বাড়তি খরচ দেখানো বা মূল্য বাড়িয়ে বিল প্রদর্শনের মতো কৌশলও এখন আর কাজ করছে না। তার মতে, এগুলো সম্ভব হয়েছে সুশাসন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কঠোর নজরদারির ফলেই।
একসময় অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল ডলার সংকট। তবে গভর্নর জানান, এখন আর সেই সংকট নেই। গত এক মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে ১ বিলিয়ন ডলার কিনেছে, কিন্তু তাতেও ডলারের দাম বাড়েনি—যা বাজারে ডলারের পর্যাপ্ত সরবরাহের ইঙ্গিত দেয়। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, বর্তমানে রয়েছে টাকার তারল্য সংকট। ব্যাংকগুলোতে আমানত প্রত্যাশিত হারে বাড়ছে না এবং খেলাপি ঋণও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখনো মুদ্রাস্ফীতি। গভর্নর বলেন, মুদ্রাস্ফীতি ৫ শতাংশের নিচে নামাতে সময় লাগবে। এর জন্য কৃষি উৎপাদন বাড়ানো, আমদানির খরচ কমানো এবং বাজারে জালিয়াতি রোধ করা জরুরি।
ব্যাংক খাতের কাঠামোগত সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি জানান, জুনের রিপোর্ট অনুযায়ী খেলাপি ঋণের হার প্রায় ৩০ শতাংশে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় পাঁচটি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। তার আশাবাদ, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে আমানতকারীরা নিরাপদ থাকবেন এবং ব্যাংকগুলোও ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াবে।
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, লোকসানি ব্যাংকে বোনাস বন্ধের সিদ্ধান্ত দীর্ঘদিনের দাবির প্রতিফলন। তার ভাষায়, “যখন একটি ব্যাংক মূলধন সংকটে ভুগছে, তখন কর্মকর্তাদের বোনাস দেওয়া মানে আমানতকারীদের অর্থকে ঝুঁকির মুখে ফেলা।”
যদিও ব্যাংক খাত সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, কিছু বড় চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে—
খেলাপি ঋণের হার অস্বাভাবিকভাবে বেশি।
কিছু ব্যাংক রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অকারণে ঋণ বিতরণ করছে।
ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছে দক্ষতার ঘাটতি।
সাইবার ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে।
সবশেষে গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের ঘোষণা শুধু একটি নিয়ম নয়, বরং একটি বার্তা। সেই বার্তাটি হলো—লোকসানি ব্যাংক থেকে আর ব্যক্তিগত লাভ নয়; বরং ব্যাংকের স্থিতিশীলতা ও অর্থনীতির স্বার্থকে আগে দেখতে হবে। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ব্যাংক কর্মকর্তারা আরও দায়িত্বশীল হবেন, আমানতকারীর আস্থা ফিরবে এবং ব্যাংক খাত ধীরে ধীরে মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে।