প্রকাশিত : ০৯:১৯
০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৯:২৩
০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সংগ্রাম দত্ত
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যে ক’জন ব্যক্তিত্ব চিরস্মরণীয়, তাঁদের অন্যতম জেনারেল এম এ জি (মুহাম্মদ আতাউল গণি) ওসমানী। তিনি শুধু একজন সেনাপ্রধান ছিলেন না, ছিলেন মুক্তির সংগ্রামের কৌশলবিদ, জাতীয় নেতৃত্বের আস্থাভাজন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রগঠনের অন্যতম পথিকৃৎ। তাঁর জীবন, কর্ম ও অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়।
জন্ম ও পারিবারিক পটভূমি:
১৯১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জ শহরে জন্মগ্রহণ করেন এম এ জি ওসমানী। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি সিলেট জেলার ওসমানীনগর উপজেলার দয়ামীরে। পিতা খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ছিলেন আসাম প্রদেশের সুনামগঞ্জ মহকুমার সাব ডিভিশনাল অফিসার (এসডিও) এবং মাতা জোবেদা খাতুন ছিলেন শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা নারী। এমন পরিবারেই তিনি বড় হয়ে ওঠেন, যেখানে শিক্ষা ও শৃঙ্খলার পরিবেশ বিদ্যমান ছিল।
শিক্ষাজীবনে বিস্ময়কর কৃতিত্ব:
ওসমানীর শিক্ষাজীবন ছিল অনন্য। ১৯৩৪ সালে সিলেট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পুরো ব্রিটিশ ভারতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। তাঁর এই সাফল্য তাঁকে এনে দেয় ব্রিটিশ সরকারের মর্যাদাপূর্ণ ‘প্রাইওটোরিয়া পুরস্কার’। পরবর্তীতে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩৮ সালে স্নাতক ডিগ্রি এবং ১৯৩৯ সালে ভূগোলে এম.এ. সম্পন্ন করেন। শৈশব থেকেই তাঁর মধ্যে এক অদম্য মনোবল, দেশপ্রেম এবং নেতৃত্বের বীজ সুপ্ত ছিল।
সামরিক জীবনের উত্থান:
১৯৩৯ সালে তিনি ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করেন এবং দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে ১৯৪২ সালে মেজর হন। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হলে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সেখানে তিনি ডেপুটি চিফ অফ জেনারেল স্টাফ, ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কসহ নানা পদে দায়িত্ব পালন করেন। শৃঙ্খলা, দক্ষতা ও নেতৃত্বগুণের জন্য তিনি ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন। ১৯৬৭ সালে কর্নেল পদে থেকে অবসর নেন।
মুক্তিযুদ্ধে সর্বাধিনায়ক:
১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তানি সেনাদের হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে বাঙালি অফিসার ও নেতারা ভারতের আশ্রয় নেন। কর্নেল ওসমানী তখনই সামনে আসেন। প্রথমদিকে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হলেও মুক্তিকামী সহযোদ্ধাদের অনুরোধে তিনি নেতৃত্ব দিতে রাজি হন। এপ্রিলের শুরুতে আগরতলা ও তেলিয়াপাড়ায় গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর কাঠামো নির্ধারিত হয়।
১১ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতারে ভাষণের মাধ্যমে তাঁকে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করেন। ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি এই পদে দায়িত্ব নেন। তাঁর নির্দেশে পুরো বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং প্রতিটি সেক্টরে কমান্ডার নিয়োগ দেওয়া হয়।
কৌশল ও যুদ্ধনীতি:
প্রথমে তিনি পাকিস্তানি সেনাদের ছাউনিতে আটকে রাখার এবং তাদের যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করার কৌশল গ্রহণ করেন। পরে বুঝতে পারেন, সংখ্যায় কম হলেও গেরিলা কৌশলই হবে সবচেয়ে কার্যকর। সেই অনুযায়ী প্রাক্তন ইপিআর, আনসার, পুলিশ ও তরুণ যোদ্ধাদের নিয়ে গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলেন। তাঁর নির্দেশনায় নৌ-কমান্ডো বাহিনী গঠিত হয়, যারা আগস্ট থেকে নদীপথে শত্রুর চলাচল প্রায় অচল করে দেয়। যুদ্ধের শেষদিকে সীমিত আকারে বিমান ইউনিটও গঠন করেন।
বিজয় ও স্বাধীনতার সূর্যোদয়:
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানি সেনারা যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। যদিও আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ওসমানী সরাসরি উপস্থিত ছিলেন না, তাঁর কৌশলগত নেতৃত্বই ছিল বিজয়ের ভিত্তি। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ তাঁকে প্রথম সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল পদমর্যাদায় নিয়োগ দেয়।
স্বাধীনতার পরের ভূমিকা:
১৯৭২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সেনাপ্রধান হিসেবে থেকে অবসর নেন। এরপর রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে সিলেট-৬ আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রী হন। ডাক, তার, টেলিযোগাযোগ এবং নৌ–বিমান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলান। কিন্তু বাকশাল প্রবর্তনের বিরোধিতা করে ১৯৭৫ সালে তিনি মন্ত্রিত্ব ও দলীয় সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেন। পরে জাতীয় জনতা পার্টি গঠন করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নেন, যদিও বিজয়ী হতে পারেননি।
শেষ প্রহর:
১৯৮২ সালে এরশাদ সামরিক আইন জারি করলে প্রতিবাদ জানান এবং রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় তাঁকে সিলেটে হযরত শাহজালাল মাজারসংলগ্ন কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
সম্মাননা ও উত্তরাধিকার-
১৯৮৫ সালে তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখতে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘ওসমানী মেমোরিয়াল হল’। সিলেটে স্থাপিত হয়েছে এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এমআইএসটি-তে রয়েছে ‘ওসমানী হল’। তাঁর জন্মভিটেও আজ স্মৃতিচিহ্নে ভরপুর।
উপসংহার:
জেনারেল এম এ জি ওসমানী শুধু মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ছিলেন না; তিনি ছিলেন মুক্তির সংগ্রামের স্থপতি, রাজনীতির সৎ ও সাহসী কণ্ঠস্বর এবং জাতির অকৃত্রিম অভিভাবক। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় বাংলাদেশকে নতুন দিকনির্দেশনা দিয়েছে। তাঁর নাম ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে।