প্রকাশিত : ০৬:২৬
০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ হিসেবে প্রবাসীদের অনস্বীকার্য ভূমিকা আজ সর্বজনস্বীকৃত। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান এই খাত দেশের জিডিপিতে প্রায় ১২ শতাংশ অবদান রাখছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপ ও মন্দার মধ্যেও এই খাতের কর্মীরা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে রেকর্ড ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২৩ শতাংশ বেশি। এমনকি বৈশ্বিক মহামারির সময়েও ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবাসী আয় আগের বছরের তুলনায় ৩৬.১ শতাংশ বেড়েছিল। এই পরিসংখ্যান সরাসরি প্রমাণ করে যে, প্রবাসীরাই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সবচেয়ে বড় অবদান রাখছেন।
কিন্তু এই বিশাল অর্থনৈতিক অবদানের বিপরীতে প্রবাসীদের জীবনে রয়েছে এক অন্ধকার দিক। মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো প্রধান শ্রমবাজারগুলোতে তারা প্রায়শই অবহেলা, হয়রানি ও বঞ্চনার শিকার হন। বিশেষ করে, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন বা দূতাবাসগুলোতে তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হয় না; বরং সেবার পরিবর্তে পদে পদে হয়রানি করা হয় বলে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ রয়েছে। এই প্রতিবেদনটি কেবল অভিযোগের পুনরাবৃত্তি নয়, বরং সরকারি উদ্যোগ ও তার বাস্তবায়নের মধ্যেকার ফারাক চিহ্নিত করে প্রবাসীদের সমস্যার মূল কারণ বিশ্লেষণ করবে। একই সঙ্গে, প্রবাসীদের জন্য সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার একটি টেকসই পথরেখাও তুলে ধরা হবে।
প্রবাসীদের বড় অভিযোগগুলোর একটি হলো বিদেশে অবস্থিত দূতাবাস বা হাইকমিশনে সেবা নিতে গিয়ে হয়রানির শিকার হওয়া। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং বিভিন্ন দেশের মিশনের একটি ধারাবাহিক চিত্র। এসব প্রতিষ্ঠান, যেগুলো প্রবাসীদের আশ্রয়স্থল ও সহায়তার কেন্দ্র হওয়ার কথা, প্রায়শই তাদের জন্য হয়রানির কেন্দ্রে পরিণত হয়। এই অব্যবস্থাপনা শুধু প্রবাসীদের ব্যক্তিগত কষ্ট বাড়ায় না, বরং বাংলাদেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতকেও সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করে।
এর একটি সুনির্দিষ্ট উদাহরণ হলো ওমানে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস। সেখানে কর্মরত প্রবাসীদের অভিযোগ, তারা মাস্কাট মিশনের উপপ্রধান ও মিনিস্টার সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছেন। এই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে প্রবাসীরা ন্যূনতম সেবাও পাচ্ছেন না; বরং কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছেন। প্রবাসীরা দাবি করেছেন, এই সমস্যার সমাধানে রাষ্ট্রদূতসহ অসৎ কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করতে হবে। এই ধরনের ঘটনা সরকারি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতার ঘাটতিকে স্পষ্ট করে।
একইভাবে, সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনের একটি স্বেচ্ছাচারী প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করেছে। প্রবাসীদের অভিযোগ, সেখানে কর্মী নিয়োগের জন্য নতুন 'আইপি সত্যায়ন' পদ্ধতি চালু করা হয়েছে, যা কোনো সরকারি গেজেট বা সিঙ্গাপুর সরকারের নোটিশ ছাড়াই কার্যকর করা হয়েছে। এই পদ্ধতির কারণে আবেদনকারী কোম্পানিগুলোকে একটি নির্দিষ্ট ফি (১২ ডলার) দিয়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে সত্যায়ন করাতে হয় এবং কোম্পানির প্রতিনিধিকে উপস্থিত থাকতে হয়, যা বাড়তি ঝামেলা সৃষ্টি করছে। এর ফলে অনেক সিঙ্গাপুরীয় কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিতে আগ্রহ হারাচ্ছে এবং বিকল্প দেশ থেকে কর্মী নিয়োগ করছে। এতে হয়রানির পাশাপাশি বাংলাদেশের শ্রমবাজার সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ধরনের জটিলতা কেবল প্রশাসনিক ত্রুটি নয়, বরং একটি কাঠামোগত দুর্বলতা, যা সুশাসনের অভাবকে প্রতিফলিত করে। যখন দূতাবাস নিজেই এমন নিয়ম তৈরি করে যা প্রবাসীদের স্বার্থবিরোধী, তখন প্রশ্ন ওঠে—এর পেছনে কোনো বাণিজ্যিক স্বার্থ জড়িত কি না। একজন প্রবাসী অভিযোগ করেছেন যে, অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে সত্যায়ন ছাড়াই ম্যানপাওয়ার কার্ড পাওয়া যায়। এটি প্রমাণ করে যে, প্রশাসনিক জটিলতার পাশাপাশি দুর্নীতিও এই হয়রানির বড় কারণ।
এই সমস্যার আরেকটি দিক হলো দালালচক্রের প্রভাব। সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিজেই স্বীকার করেছেন যে, ভিসা প্রক্রিয়াকরণের সব ব্যয় নিয়োগকর্তাদের বহন করার কথা থাকলেও দালালসহ নানা চক্রের কারণে কর্মীদের অতিরিক্ত খরচ ও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এটি দূতাবাস ও দালালচক্রের জটিল সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। যখন দূতাবাসগুলো প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও সহজ করতে ব্যর্থ হয়, তখন দালালদের প্রভাব বাড়ে। এটি এমন এক দুষ্টচক্র, যা প্রবাসীদের শোষণ করে এবং তাদের আর্থিক ও মানসিক দুর্দশা বাড়িয়ে তোলে।
প্রবাসীদের কল্যাণে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে, তা অস্বীকার করা যায় না। তাদের জন্য বেশ কিছু আইনি, আর্থিক ও প্রশাসনিক কাঠামো বিদ্যমান রয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক, জিআরএস (অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা) এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হটলাইনগুলো প্রবাসীদের অভিযোগ জানানোর সুযোগ তৈরি করেছে। মৌলভীবাজার জেলার পুলিশের মতো কিছু স্থানীয় প্রশাসনও প্রবাসীদের জন্য হটলাইন চালু করেছে। আর্থিক ও কল্যাণমূলক সেবার ক্ষেত্রে, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড (WEWB) প্রবাস ফেরত অসুস্থ কর্মীদের সর্বোচ্চ দেড় লক্ষ টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা সহায়তা, বৈধভাবে বিদেশে গমনকারী মৃত কর্মীর পরিবারকে ৩ লক্ষ টাকা অনুদান, শিক্ষাবৃত্তি, সেইফ হোম ও আইনগত সহায়তা প্রদান করে।
এসব উদ্যোগের পাশাপাশি প্রবাস ফেরত কর্মীদের পুনর্বাসনের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক সহজ শর্তে ৪ শতাংশ সরল সুদে ঋণ প্রদান করে। বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য সরকার ২.৫ শতাংশ নগদ প্রণোদনাও দিয়ে থাকে। কাগজে-কলমে এই কাঠামো প্রবাসীদের জন্য একটি শক্তিশালী সুরক্ষা ব্যবস্থা মনে হলেও বাস্তবে তা ততটা কার্যকর নয়।
প্রবাসীদের অসন্তোষের একটি বড় অংশই সরকারি সেবার দুর্বল বাস্তবায়ন নিয়ে। উদাহরণস্বরূপ, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রম কাগজে প্রশংসনীয় হলেও, এক অনলাইন মন্তব্যকারী অভিযোগ করেছেন যে—“১% প্রবাসীও লোন পান কি না সন্দেহ আছে।” এটি প্রমাণ করে যে, সরকারি সেবাগুলো “কাগজে আছে, বাস্তবে নেই”—এমন ধারণা জনমনে প্রবল। এর পেছনে রয়েছে কয়েকটি কারণ—প্রথমত, অনেক প্রবাসী এসব সেবার ব্যাপারে জানেন না; দ্বিতীয়ত, আবেদন প্রক্রিয়া এতটাই জটিল যে সাধারণ কর্মীদের পক্ষে সম্পন্ন করা কঠিন; তৃতীয়ত, অতিরিক্ত ঘুষ বা হয়রানির কারণে মানুষ সেবা নিতে আগ্রহ হারায়। এর ফলে আস্থার সংকট তৈরি হয়, যা দেশের ভাবমূর্তিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
অদক্ষ জনশক্তি রপ্তানি বাংলাদেশের আরেকটি বড় সমস্যা। সরকার জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)-এর অধীনে ১০৪টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) এবং ৬টি মেরিন টেকনোলজি ইনস্টিটিউট পরিচালনা করছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমা, স্বল্প মেয়াদি (৩-৬ মাস) এবং বিভিন্ন ভাষা প্রশিক্ষণ কোর্স চালু রয়েছে। এসব প্রশিক্ষণের খরচ অত্যন্ত কম, কোথাও কোথাও প্রায় বিনামূল্যে দেওয়া হয়। তবু বণিক বার্তা-এর তথ্যমতে, সরকারি ১১০ টিটিসি ও আইএমটি প্রতিবছর লক্ষাধিক লোককে প্রশিক্ষণ দিলেও বিদেশগামী কর্মীদের ৯০ শতাংশই অদক্ষ থেকে যায়। কারণ—প্রশিক্ষণের প্রতি আগ্রহের অভাব, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ঘাটতি এবং প্রশিক্ষণের মান আন্তর্জাতিক চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়া। এর ফলে প্রবাসীরা অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে বিদেশে গিয়ে হয়রানি ও শোষণের শিকার হন এবং দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহও সীমিত থেকে যায়।
সবশেষে বলা যায়, সরকারের নীতি ও উদ্যোগগুলো প্রশংসনীয় হলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন, প্রচার ও জবাবদিহিতায় ঘাটতি রয়েছে। প্রবাসীদের অভিযোগগুলো বিচ্ছিন্ন নয়; বরং একটি কাঠামোগত সমস্যার প্রতিফলন। প্রবাসীদের সম্মান, নিরাপত্তা ও টেকসই অভিবাসন নিশ্চিত করতে হলে জরুরি কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে—
১. সেবার মান উন্নয়ন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা—দূতাবাসগুলোর কার্যক্রম স্বচ্ছ করতে হবে, দালালচক্র নির্মূল করতে হবে, সিঙ্গাপুরের মতো বিতর্কিত প্রক্রিয়া বাতিল করতে হবে।
২. প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার সংস্কার—প্রশিক্ষণের মান আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদার সাথে সমন্বয় করতে হবে এবং উপজেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণ সুবিধা বিস্তার করতে হবে।
৩. সচেতনতা বৃদ্ধি ও আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা—সরকারি সেবাগুলোর ব্যাপারে প্রচারণা বাড়াতে হবে এবং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে।
৪. সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা—প্রবাসীদের কেবল রেমিট্যান্সের উৎস নয়, দেশের সম্মানিত নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। বিমানবন্দর থেকে দূতাবাস পর্যন্ত সর্বত্র তাদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড; তাদের প্রতি অবহেলা বা হয়রানি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।