প্রকাশিত :  ১৬:৫২
০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

প্রধান উপদেষ্টা-সেনাপ্রধান বৈঠক: নির্বাচনী সমন্বয়ে নতুন বার্তা, গুজব রুখতে কৌশলগত পদক্ষেপ!

✍️ বিশেষ প্রতিনিধি

প্রধান উপদেষ্টা-সেনাপ্রধান বৈঠক: নির্বাচনী সমন্বয়ে নতুন বার্তা, গুজব রুখতে কৌশলগত পদক্ষেপ!

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন নির্বাচনের দোরগোড়ায়। নির্বাচনকে ঘিরে দেশি-বিদেশি নানা কূটনৈতিক বার্তা, রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং জনমত তৈরি হচ্ছে। এরই মধ্যে আজ সোমবার একটি তাৎপর্যপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের মধ্যে। যদিও এটি ‘সৌজন্য সাক্ষাৎ’ হিসেবে প্রচার করা হয়েছে, তবে বৈঠকের সময়, বার্তা এবং বক্তব্যের ভেতর দিয়ে যে রাজনৈতিক ও কৌশলগত গুরুত্ব উঠে এসেছে—তা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৈঠকে সেনাবাহিনীর ভূমিকা, বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেনাবাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, “আমি জাতির প্রতি অঙ্গীকার করেছি এমন একটি নির্বাচন উপহার দেওয়ার জন্য, যা ভোটার উপস্থিতি, নতুন ও নারী ভোটারের অংশগ্রহণ, নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়ে বৈশ্বিক আস্থা এবং গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের উৎসবমুখর পরিবেশের দিক থেকে আলাদা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।”

অন্যদিকে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান আশ্বাস দিয়ে বলেন, “পুরো সেনাবাহিনী সরকারের সব উদ্যোগ ও কর্মসূচি সফল করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।” একই সঙ্গে তিনি গুজবের প্রতি মনোযোগ না দেওয়ার আহ্বান জানান, যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা হিসেবে ধরা হচ্ছে।

বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে সেনাবাহিনীর ভূমিকা সবসময়ই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছে। অতীতে সেনা মোতায়েনকে ভোটারদের আস্থার অন্যতম গ্যারান্টি হিসেবে দেখা হতো। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে এ বৈঠকের পর সেনাবাহিনী শুধু নিরাপত্তা বাহিনী হিসেবে নয়, বরং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার এক শক্তিশালী সহযোগী হিসেবে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ, ভোটকেন্দ্রে শৃঙ্খলা রক্ষা, গুজব দমন এবং সাইবারস্পেসে ভুয়া প্রচারণা মোকাবিলায় সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে গুজব রুখতে সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সক্ষমতা প্রশাসনের জন্য সহায়ক হতে পারে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নির্বাচনের আগে গুজব অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। অতীতে ভুয়া প্রচারণা, গুজব বা বিভ্রান্তিকর তথ্য বহুবার সহিংসতার জন্ম দিয়েছে। এ কারণেই সেনাপ্রধানের বক্তব্য—“গুজবের প্রতি মনোযোগ না দেওয়ার আহ্বান”—আসলে এক সতর্কবার্তা।

এটি জনগণের উদ্দেশে যেমন একটি আশ্বাস, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিও ইঙ্গিত—গুজব ছড়িয়ে নির্বাচনী পরিবেশ অস্থিতিশীল করার যে চেষ্টা থাকতে পারে, তা প্রতিহত করতে সেনাবাহিনী প্রস্তুত। বিশ্লেষকদের মতে, এ বক্তব্য বিনিয়োগকারী, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং সাধারণ মানুষের কাছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বার্তাই বহন করছে।

প্রধান উপদেষ্টা এবং সেনাপ্রধানের এই বৈঠক সরাসরি রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও একটি সংকেত। অন্তর্বর্তী সরকার স্পষ্ট করে দিচ্ছে, প্রশাসন ও সেনাবাহিনী একই সুরে কাজ করছে। অর্থাৎ, নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ সীমিত হয়ে আসছে।

রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীর উপস্থিতি দাবি করে আসছে। এবার অন্তর্বর্তী সরকার নিজেই সেনাবাহিনীর সক্রিয় সহযোগিতার কথা তুলে ধরায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির প্রতিও এক ধরনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা যেতে পারে।

বাংলাদেশের নির্বাচন সবসময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য কূটনৈতিক চাপ বাড়াচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধানের এ আশ্বাস আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ইতিবাচক সঙ্কেত হিসেবে কাজ করবে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যে ‘ভোটার উপস্থিতি, নারী অংশগ্রহণ এবং বৈশ্বিক আস্থা’ শব্দগুলো আসলে বিদেশি পর্যবেক্ষক ও কূটনীতিকদের জন্য একটি পরিকল্পিত বার্তা। এতে বোঝানো হচ্ছে—বাংলাদেশ একটি অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। প্রতিবার নির্বাচনের আগে অস্থিরতার কারণে শেয়ারবাজার ও বিনিয়োগ প্রবাহে ধাক্কা লাগে। তবে এবার প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের বৈঠক বিনিয়োগকারীদের কাছে ভিন্ন বার্তা দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা দেখছেন—সরকার ও সেনাবাহিনী একযোগে কাজ করছে, গুজব মোকাবিলা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার পরিকল্পনা আছে। এতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের ঝুঁকি কিছুটা হলেও কমবে। বিশেষ করে অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, তথ্যপ্রযুক্তি ও শিল্প খাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে এ বার্তা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

তবে সবকিছু ইতিবাচক হলেও সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে—

 ১. রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ: নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক মিছিল, সভা-সমাবেশে সংঘর্ষের আশঙ্কা থেকেই যায়।

 ২. ডিজিটাল গুজব রোধ: ফেসবুক, ইউটিউব বা টেলিগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মে ভুয়া খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।

 ৩. ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তা: গ্রামাঞ্চলে ভোটকেন্দ্রগুলোতে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা বড় চ্যালেঞ্জ।

 ৪. আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলা: নির্বাচন ঘিরে বিদেশি শক্তিগুলো বিভিন্ন সময় চাপ প্রয়োগ করতে পারে।

এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের যৌথ পদক্ষেপ অপরিহার্য।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বৈঠক নিছক আনুষ্ঠানিক নয়। বরং এটি একটি কৌশলগত পদক্ষেপ, যা তিনটি বার্তা দিয়েছে—

দেশবাসীর প্রতি: নির্বাচন হবে শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ।

রাজনৈতিক দলের প্রতি: প্রশাসন ও সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি: বাংলাদেশ বৈশ্বিক মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে যাচ্ছে।

অতএব, বলা যায় এই বৈঠক আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।


Leave Your Comments




মত-বিশ্লেষণ এর আরও খবর