প্রকাশিত :  ১৩:৪৫
০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১৫:৫২
০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মুনাফা সত্ত্বেও কেন বাড়ছে না যমুনা ব্যাংকের শেয়ারের দর?

নেপথ্যে বাজারের দুর্বলতা ও কাঠামোগত সংকট

মুনাফা সত্ত্বেও কেন বাড়ছে না যমুনা ব্যাংকের শেয়ারের দর?

বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা: বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে একটি অদ্ভুত বৈপরীত্য দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগকারীদের কৌতূহল ও হতাশা বাড়িয়ে তুলছে। যমুনা ব্যাংক লিমিটেড (টিকার: JAMUNABANK) ধারাবাহিকভাবে ভালো মুনাফা করছে, শেয়ারহোল্ডারদের নিয়মিত লভ্যাংশ দিচ্ছে, এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক "টেকসই আর্থিক প্রতিষ্ঠান" হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে। তবুও এর শেয়ারের দর প্রত্যাশিত গতিতে বাড়ছে না। প্রশ্ন উঠছে— মুনাফা ও অনুকূল আর্থিক সূচক থাকা সত্ত্বেও কেন বাজারে বিনিয়োগকারীরা দ্বিধাগ্রস্ত?

এই প্রতিবেদনে যমুনা ব্যাংকের আর্থিক চিত্র, ব্যাংকিং খাতের সংকট, সামগ্রিক পুঁজিবাজারের দুর্বলতা এবং নীতিগত সীমাবদ্ধতা বিশ্লেষণ করা হবে। উদ্দেশ্য— এই আপাত-বৈপরীত্যের অন্তর্নিহিত কারণ অনুসন্ধান।

যমুনা ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা— আলো ও অন্ধকার

যমুনা ব্যাংক গত কয়েক বছরে ধারাবাহিকভাবে স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। সর্বশেষ ট্রেইলিং টুয়েলভ মান্থস (TTM) আর্নিংস পার শেয়ার (EPS) দাঁড়িয়েছে ৩.১৭ টাকা, যা নির্দেশ করে ব্যাংকটি কার্যক্রম থেকে সুদৃঢ় মুনাফা অর্জন করছে।

এছাড়া শেয়ারহোল্ডারদের নিয়মিত লভ্যাংশ প্রদান অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ ঘোষিত লভ্যাংশ ছিল নগদ ১৭.৫% এবং স্টক বোনাস ৬.৫%— বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যা যথেষ্ট উচ্চ মানদণ্ড।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে যমুনা ব্যাংককে "টেকসই আর্থিক প্রতিষ্ঠান" হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, পর্যাপ্ত মূলধন, খেলাপি ঋণের নিয়ন্ত্রণ এবং অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলায় ব্যাংকটির অবস্থান তুলনামূলকভাবে ভালো।

তবে সবকিছুই ইতিবাচক নয়। ২০২৫ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ব্যাংকটির নিট আয় দাঁড়ায় ১৪০ কোটি টাকা, যা প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় প্রায় ২৭ শতাংশ কম। একই সময়ে নগদ প্রবাহও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। যেহেতু বাজার ভবিষ্যতের প্রবণতা বিবেচনায় রাখে, তাই এই নিম্নমুখী আয় বিনিয়োগকারীদের শঙ্কিত করছে।

EPS কি সব ব্যাখ্যা করে?

বাংলাদেশি খুচরা বিনিয়োগকারীরা প্রায়ই কেবল EPS-এর দিকে নজর দেন। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে বিনিয়োগ মূল্যায়নে আরও সূচক গুরুত্বপূর্ণ, যেমন প্রাইস-টু-আর্নিংস (P/E) অনুপাত এবং প্রাইস-টু-বুক (P/B) অনুপাত।

যমুনা ব্যাংকের পিই অনুপাত বর্তমানে ৩.২০, যেখানে ব্যাংকিং খাতের গড় ৮.৬। এটি ইঙ্গিত করে বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকটির আয়ে পূর্ণ আস্থা রাখছেন না অথবা ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন।

আরও উদ্বেগজনক হলো পিবি অনুপাত। যমুনা ব্যাংকের পিবি অনুপাত মাত্র ০.৮৫, অর্থাৎ বাজার ব্যাংকটির প্রকৃত সম্পদমূল্যের চেয়ে কম দাম নির্ধারণ করছে। বিনিয়োগকারীরা আশঙ্কা করছেন, বইয়ে দেখানো সম্পদের (বিশেষ করে ঋণ) মান হয়তো পুরোপুরি আদায়যোগ্য হবে না।

ব্যাংকিং খাতের আস্থাহীনতা

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে এক গুরুতর সংকটে। ২০২৫ সালের মার্চ শেষে মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা— যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৪ শতাংশেরও বেশি। এটি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ।

যদিও যমুনা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার তুলনামূলকভাবে কম (৬.৫%), তবুও বড় ব্যাংকগুলোর দুরবস্থা পুরো খাতের ওপর এক ধরনের "সংক্রামক আস্থাহীনতা" তৈরি করেছে। জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৯০ শতাংশে পৌঁছানো কিংবা ইসলামী ব্যাংকের ২৭ শতাংশ খেলাপি ঋণ বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত করছে।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ঋণ জালিয়াতি এবং দুর্বল করপোরেট সুশাসন। বিশ্বব্যাংক ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকে "ঝুঁকিপূর্ণ ও কাঠামোগত দুর্বলতাপূর্ণ" বলে উল্লেখ করেছে।

ফলে, যমুনা ব্যাংক যত ভালোই পারফর্ম করুক না কেন, খাতগত সংকট তার শেয়ারের দরকে চেপে ধরছে।

পুঁজিবাজারের দুর্বল ভিত্তি

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা নতুন নয়। ১৯৯৬ ও ২০১১ সালের ধস বিনিয়োগকারীদের মনে এখনো গভীর দাগ কেটে আছে। বাজার নিয়ন্ত্রণ দুর্বল, কারসাজির প্রবণতা প্রবল এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ এখনো সীমিত।

মিউচুয়াল ফান্ড খাত জিডিপির এক শতাংশেরও কম। নতুন ও ভালো কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত হচ্ছে না; বরং দুর্বল ভিত্তির শেয়ারগুলোই অনেক সময় সূচককে প্রভাবিত করে। ফলে মৌলিকভাবে শক্তিশালী যমুনা ব্যাংকের শেয়ার তুলনামূলকভাবে অবহেলিত থাকে।

বিনিয়োগকারীরা দ্রুত লাভের আশায় অস্থির শেয়ারের পেছনে ছুটছেন, আর স্থিতিশীল লভ্যাংশ প্রদানকারী শেয়ারগুলোকে "নিষ্ক্রিয়" হিসেবে দেখছেন।

কঠোর মুদ্রানীতি ও তার প্রভাব

বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে রেপো রেট ১০ শতাংশে স্থির রেখেছে। এর ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ১০.৫০ শতাংশ পর্যন্ত সুদে আমানত সংগ্রহ করছে।

যখন একজন বিনিয়োগকারী ঝুঁকি ছাড়া ১০ শতাংশ রিটার্ন পেতে পারেন, তখন তিনি কেন ৮ শতাংশ লভ্যাংশের জন্য যমুনা ব্যাংকের শেয়ার কিনবেন? এই ঝুঁকি-সামঞ্জস্যপূর্ণ বিবেচনাতেই পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সরে গিয়ে ব্যাংকের মেয়াদী আমানতে প্রবাহিত হচ্ছে।

ফলাফল— বাজারে তারল্য সংকট, যা শেয়ারের দর বৃদ্ধিকে আরও বাধাগ্রস্ত করছে।

একটি "নিখুঁত সংকট"-এর প্রতিচ্ছবি

যমুনা ব্যাংকের শেয়ারের দাম না বাড়ার কারণ একক নয়। বরং এটি একাধিক কাঠামোগত সমস্যার সমন্বয়—

১. ব্যাংকিং খাতের সংক্রামক আস্থাহীনতা

২. পুঁজিবাজারের ঐতিহাসিক দুর্বলতা

৩. কঠোর মুদ্রানীতি ও ঝুঁকি-মুক্ত বিকল্প বিনিয়োগের আকর্ষণ


Leave Your Comments




ব্যাংক-বীমা এর আরও খবর