প্রকাশিত :  ০৭:১৭
৩১ আগষ্ট ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৭:৪৭
৩১ আগষ্ট ২০২৫

নিরালম্ব ইতিকথা!

নিরালম্ব ইতিকথা!

-রেজুয়ান আহম্মেদ

শহরের গলিতে সন্ধ্যা নামে এক অদ্ভুত ক্লান্তিতে। যে ধূলো আর হট্টগোলের মধ্যে দিনের শুরু হয়েছিল, সন্ধ্যার জমাট আঁধারে তার বিষণ্ণতাটুকু যেন আরও প্রকট হয়ে ওঠে। বলাই নামের মধ্যবিত্ত যুবকটি তার ছোট ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকে। কয়েক মাস আগে এই শহরই এক গণ-আন্দোলনের তাপে ফুটছিল, পথে পথে নেমেছিল অসংখ্য প্রাণ। সেই উত্তাপের রেশ এখনো পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি, কিন্তু তার স্থানে এখন এক নতুন অস্থিরতা। বলাইয়ের মনে হয়, যেন একটি জ্বর নেমে যাওয়ার পর শরীরে এক নতুন ব্যথা দানা বেঁধেছে। যে মুক্তির বাতাস আসার কথা ছিল, তা যেন এক ধরনের চাপা শ্বাসকষ্ট হয়ে ফিরে এসেছে।

​তার কানে ভেসে আসে কতিপয় বিক্ষুব্ধ যুবকের স্লোগান। তাদের পোশাকে এখনো আন্দোলনের ছায়া, মুখে এখনো প্রতিবাদের আগুন। তারা নতুন করে দাবি তুলছে, জাতীয় পার্টির মতো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হোক, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ চাওয়া হচ্ছে । বলাই দেখে, এই যুবকদের সঙ্গে আরেক দল মানুষের সংঘর্ষ হচ্ছে। বিজয়নগরের জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হচ্ছে, পুলিশের সামনেই চলছে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া । তার মনে হয়, এ কেমন পরিবর্তন? পুরাতন স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছিল, তার মূল লক্ষ্য ছিল একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাছে রাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দেওয়া । কিন্তু এখন তো শুধু মুখের বদল হয়েছে, খেলার নিয়ম বদলায়নি। পুরাতন দলগুলোকে নিষিদ্ধ করার দাবি  আর নতুন করে মারামারি, এই সবই যেন একটি বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ জীবন। এটি কোনো নতুন ভোরের আভাস নয়, পুরাতন রাতেরই একটি নতুন সংস্করণ। যে বিপুল প্রত্যাশা আর স্বপ্নের ভার নিয়ে গণ-অভ্যুত্থান এসেছিল, তা এখন ক্ষুদ্র কোন্দল আর ক্ষমতাকেন্দ্রিক খেলায় পরিণত হয়েছে। মানুষ ভেবেছিল, মূল সমস্যার সমাধান হয়েছে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কেবল মুখগুলোই পাল্টেছে, সমস্যাগুলো পুরোনো মুখোশ পরে আবার ফিরে এসেছে। 

​এই রাজনৈতিক সংঘাতের মধ্যে বলাইয়ের মনস্তত্ত্বের গভীরে ঢুকে পড়ে এক নিরাশার বোধ। সে জানে, এই আপাতদৃষ্টিতে নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আসলে পুরোনো কাহিনীরই পুনরাবৃত্তি। যেখানে জনগণের মুক্তির কথা বলা হয়, সেখানে আসলে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির লড়াই-ই মুখ্য। এই লড়াই মানুষের বাস্তব জীবনের কোনো পরিবর্তন আনে না, কেবল নতুন করে হতাশাই জন্ম দেয়। বলাই বুঝতে পারে, এই শহরের বাতাস কেবল বিষাক্তই হয়নি, এই বিষ এক প্রজন্মের মন থেকে আরেক প্রজন্মের মনে প্রবেশ করে তাকেও বিষাক্ত করে তুলছে।

​শহরের এই দমবন্ধ করা পরিস্থিতিতে বলাই তার প্রিয় বন্ধু গণেশ বাবুর চায়ের দোকানে আশ্রয় নেয়। গণেশ বাবু একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন, কিন্তু এখন তিনি রাস্তার ধারের একটি ছোট চায়ের দোকানের মালিক। তার চোখে ইতিহাসের ক্লান্তি, আর মুখে এক ধরনের শ্লেষাত্মক হাসি।

​বলাই এসে বসতেই গণেশ বাবু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলেন, "কী হে বলাই, কেমন চলছে পন্ডিতদের রাজত্ব? শুনেছি সরকারে নাকি সব পণ্ডিতেরা বসেছেন। কে না আছে? অর্থনীতিবিদ, আইনবিদ, পরিবেশবিদ… যেন সব-পেয়েছির দেশ!"

​গণেশ বাবুর কথাগুলো বলাইয়ের কাছে তিক্ত হলেও সত্য মনে হয়। নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে কারা আছেন, তা নিয়ে গণমাধ্যমে বিস্তর আলোচনা হয়েছে । ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছেন এবং তিনি একাই ২৭টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন, যার মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রতিরক্ষা, শিক্ষা এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ও রয়েছে । গণেশ বাবু একজন একজন করে উপদেষ্টাদের নাম উল্লেখ করেন—সালেহ উদ্দিন আহমেদ, আসিফ নজরুল, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ফরিদা আখতার, নাহিদ ইসলাম, প্রমুখ । তাদের জ্ঞান, তাদের প্রজ্ঞা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, কিন্তু গণেশ বাবুর প্রশ্ন অন্য জায়গায়। 

​তিনি তার ভাঙা চায়ের কাপটি নেড়ে বলেন, "সারা বাংলাদেশ একটা বড় পরিবার, এই কথা নাকি তিনি বলেছেন । কিন্তু এই পরিবারের পেটের জ্বালা আর মনের জ্বালা কি তাদের শ্বেতপত্রে আছে?" গণেশ বাবু আরও বলেন, "এরা কেবল তত্ত্ব দিয়ে দেশ চালাতে চায়। অর্থনীতির পুনর্গঠন, দুর্নীতির প্রতিরোধ, ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা – সব শ্বেতপত্রে লেখা আছে । কিন্তু রাস্তায় হেঁটে যাওয়া একজন মানুষ কি এই শ্বেতপত্র খায়? রাজনৈতিক ম্যান্ডেট না থাকলেও এদের ভাবমূর্তি ভালো, এই কথা বলছে গবেষণা সংস্থা । কিন্তু একটা জাতির সংকট কি শুধু ভাবমূর্তি দিয়ে কাটে?" 

​বলাই বুঝতে পারে, এই নতুন সরকার এক ধরনের জ্ঞানীর শাসন। কিন্তু এই জ্ঞানী মানুষেরা সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের জটিলতা থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। তারা বড় বড় পরিকল্পনা সাজান, কিন্তু সেই পরিকল্পনার নিচে চাপা পড়ে থাকে একজন মুদি দোকানি বা একজন রিকশাচালকের বাস্তব জীবন। এটি এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা। একদল মানুষ ক্ষমতার আসনে বসেছেন, যারা হয়তো সৎ ও জ্ঞানী, কিন্তু তারা সাধারণ মানুষের জীবনের মূল সমস্যাগুলো বোঝেন না। এটিও এক ধরনের ফাঁপা বাস্তবতা, যেখানে উচ্চবর্গের বুদ্ধিবৃত্তিক সমাধান এবং নিম্নবর্গের কঠিন বাস্তবের মধ্যেকার ফারাকটিকেই ব্যঙ্গ করা হয়। এই ফারাকটিই গণেশ বাবুর কথার মূল সুর। একটি সরকার কেবল ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হলেই সফল হয় না, যদি তার মাটি মানুষের বাস্তবতার সঙ্গে কোনো সংযোগ না থাকে।

​গণেশ বাবুর চায়ের দোকানে কথার শেষে বলাইকে তার মা বাজার করার জন্য কিছু টাকা ধরিয়ে দেন। বাজারে যেতেই বলাইয়ের মনে পড়ে যায় গণেশ বাবুর কথা। এটিই এখন তার কাছে আসল পরীক্ষা। দেশের অর্থনীতির যে চিত্র কাগজে-কলমে আছে, তার সঙ্গে তার পকেটের হিসেব মেলে কিনা, তা সে দেখতে চায়।

​সে প্রথমে নূরু মিয়ার মুদি দোকানে যায়। নূরু মিয়া হাসি মুখে তাকে স্বাগত জানান, কিন্তু তার চোখের কোণে এক ধরনের হতাশা লুকানো। বলাই ডিমের দাম জিজ্ঞেস করতেই নূরু মিয়া তিক্ত হাসি হেসে বলেন, "বাবা, সরকার নাকি বলেছে মূল্যস্ফীতি কমেছে । কাগজ-কলমে ২২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন । কিন্তু দেখেন, ডিমের দাম, পেঁয়াজের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে । বাজারে কোনো পণ্যের ওপরই যেন কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই ।" 

​নূরু মিয়া তার এক হাতে কিছু ধানের দানা নিয়ে বলেন, "যখন দেশের খাদ্যমূল্য কমে যায়, তখন কাগজে-কলমে মূল্যস্ফীতিও কমে যায় । কিন্তু সেই খাদ্য কি সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকে? গবেষণা সংস্থা সিপিডি-ও বলছে, ৬ মাসেও জনজীবনে স্বস্তি আনতে পারে নাই অন্তর্বর্তী সরকার । এখন আপনি বলেন, আপনার পকেটের একশো টাকা আর সরকারি হিসাবের একশো টাকা কি সমান?" 

​নূরু মিয়ার কথা বলাইয়ের কাছে এক ধরনের দার্শনিক সত্য বলে মনে হয়। একজন সাধারণ মানুষের জন্য বিমূর্ত অর্থনৈতিক সূচকগুলোর কোনো অর্থ নেই। তার কাছে একমাত্র সত্য তার পকেট। সে দেখছে, ধনবৈষম্য দিন দিন বাড়ছে । যে সরকার জনগণের পক্ষ হয়ে এসেছে, তাদের কাজের ফল এখনও নিম্নবিত্তের কাছে পৌঁছায়নি। বাজারে প্রতিদিন নিত্যপণ্যের দামের যে ওঠানামা, তা যেন এক অদৃশ্য হাত নিয়ন্ত্রণ করছে। এই অসামঞ্জস্যতা মানুষের মনকে প্রভাবিত করে, তাদের মনে হতাশা ও অবিশ্বাস তৈরি করে। সরকারের ভালো উদ্দেশ্য থাকলেও, তার বাস্তব ফল যখন দেখা যায় না, তখন সেই উদ্দেশ্যের ওপরই মানুষের আস্থা কমে যায়। কাগজে-কলমের হিসাব আর সাধারণ মানুষের বাস্তব জীবনের মধ্যে যে বিশাল ফারাক, সেটিই এ গল্পের মূল শ্লেষ। এটি এক ধরনের ভিন্ন ইতিহাস, যা বইয়ের পাতায় নয়, মানুষের দৈনন্দিন সংগ্রামের মধ্যে লেখা হয়। 

​বাজার সেরে বলাই আবার গণেশ বাবুর কাছে ফিরে আসে। এবার তার মুখে কোনো কথা নেই। গণেশ বাবু তার নীরবতা দেখেই সব বুঝতে পারেন। তিনি একটি চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলেন, "কী হে, ইতিহাসের নতুন পাতায় কী লিখলে?"

​বলাই তখন তার পকেটের হিসেবটা দেখায়। গণেশ বাবু মাথা নাড়েন। তিনি বলেন, "তুমি তো কেবল একশো পয়সার ইতিহাস দেখলে। এর পেছনে আরেকটি ইতিহাস আছে, যা আমাদের বারবার দেখতে হয়।"

​তিনি তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণার কথা বলেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে এই ব্যবস্থা বারবার আসে, আবার বাতিল হয় । তিনি বলেন, "আমাদের গণতন্ত্র একটি বৃত্তে ঘুরছে, যেখানে শুরু আর শেষ এক বিন্দুতে এসে মিলে যায়।" নব্বইয়ের দশকের গণ-আন্দোলন হয়েছিল, যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা । কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়ন করেনি। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা হয়েছিল পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে, যা এখন আবার আদালতে বিচারাধীন । 

​গণেশ বাবু বলেন, "তুমি হয়তো ভাবছো, এবার সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এই যে নতুন সরকার, এটিও কি পুরোনো পথের পথিক হবে না? আমাদের দেশে গণতন্ত্রের বদলে বারবার ক্ষমতা দখলের চেষ্টা হয়েছে । গুজব রটছে, সেনা শাসন জারি হচ্ছে, আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা চলছে । এই সব গুজব এই অনিশ্চয়তাকেই আরও বাড়িয়ে তোলে। কারণ আমাদের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেন একটি বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ।" 

​গণেশ বাবু জানান, আমাদের রাজনৈতিক সংকট মূলত মানব চরিত্রের লোভ ও ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষার পুনরাবৃত্তি । প্রতিটি সরকার আসে, নতুন স্বপ্ন দেখায়, কিন্তু পুরোনো সমস্যার সমাধান করতে পারে না। এই চক্রাকার সময়কাল, যেখানে সব কিছু একই থাকে, মানিকীয় গল্পের একটি মূল বৈশিষ্ট্য। যেখানে এক প্রজন্মের হতাশা আরেক প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত হয়, আর রাজনৈতিক অঙ্গীকার কেবল ফাঁপা বুলি হয়েই থেকে যায়। 

​বলাই, নূরু মিয়া, আর গণেশ বাবুর এই ছোট্ট গল্পটির কোনো সমাধান নেই। বলাইয়ের ব্যক্তিগত হতাশা, নূরু মিয়ার তিক্ত হাসি আর গণেশ বাবুর ঐতিহাসিক ক্লান্তি—সবকিছুই এক বিন্দুতে মিলিত হয়ে এক অনির্দিষ্ট পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। বলাই কোনো বিপ্লবে অংশ নেয় না, কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দেয় না। সে শুধু তার শহরে, তার গলিতে, তার ছোট ঘরে ফিরে আসে। বাইরে তখন রাতের অন্ধকার আরও গভীর হয়। সে অনুভব করে, এই অন্ধকার আসলে অরাজকতার  অন্ধকার, যেখানে যুদ্ধ চলছে রাজায় প্রজায় । এই লড়াই অদৃশ্য, কিন্তু এর তাপ তেভাগা  আন্দোলনের মতোই জ্বলন্ত। 

​গল্পের শেষ এখানেই। এটি কোনো সুখ বা দুঃখের চূড়ান্ত পরিণতি নয়, কেবল একটি চলমান বাস্তবতার স্থিরচিত্র। হারাণের নাতজামাই  গল্পের মতোই, পাঠককে উত্তর খুঁজে নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষণ একটি গল্পের মোড়কে মিশে গেছে, কিন্তু তা কোনো চূড়ান্ত রায় দেয় না। এটিই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শৈলীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক—গল্পের শেষে পাঠককে একটি অনির্ধারিত পরিণতির সামনে ফেলে দেওয়া।


Leave Your Comments




সাহিত্য এর আরও খবর