প্রকাশিত : ০৯:১৫
২৭ আগষ্ট ২০২৫
সংগ্রাম দত্ত: মৌলভীবাজার জেলায় চলছে বালু লুটের মহোৎসব। জেলার রাজনগর, কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার সদর ও শ্রীমঙ্গল উপজেলার অসংখ্য নদী ও ছড়া থেকে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে পাচার করছে। আর এই বালু ব্যবসায় জড়িতরা ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। মাঝে মধ্যে প্রশাসনের অভিযানে ড্রাইভার-হেলপার আটক, ট্রাক জব্দ ও জরিমানা করা হলেও মূল গডফাদাররা অদৃশ্যই থাকেন।
শ্রীমঙ্গলের জাগছড়া: প্রকাশ্য বালু লুট:
শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৩ নং শ্রীমঙ্গল ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামের ন্যাজারিন মিশনে যাবার পথে বিস্কুট ফ্যাক্টরির সামনের জাগছড়া থেকে দীর্ঘদিন ধরে বালু উত্তোলন চলছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রভাবশালী গোষ্ঠীর মদদে হোমরাচোমরা শিপলু, মাসুম ও শাহেদের নেতৃত্বে এখান থেকে অবৈধভাবে বালু তুলে পাচার করা হয়। এই কাজে ব্যবহার করা হয় শিল্পপতি সিরাজুল ইসলাম হারুন মিয়া ও সাবেক চেয়ারম্যান রাসেন্দ্র দত্ত চৌধুরীর জমি।
ছড়ার পাশে বসবাসরত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ ভয়ে এই গডফাদারদের নাম প্রকাশ্যে বলতে চান না। তবে এলাকাবাসীর অভিমত, বিষয়টি “ওপেন সিক্রেট”—সবাই জানে কিন্তু মুখ খোলার সাহস করে না। শিল্পপতি সিরাজুল ইসলাম হারুন খবর পেয়ে নিজ জমির উপর দিয়ে বালুবাহী ট্রাক চলাচল বন্ধ করে দেন।
ফুলছড়া থেকে গ্রামে বন্যা:
শ্রীমঙ্গলের দ্বারিকা পাল কলেজ সংলগ্ন দক্ষিণ উত্তরসুর তালতলা গ্রামের ফুলছড়া থেকেও চলছে একই চিত্র। অবৈধভাবে বালু তোলার ফলে বর্ষার সময় আশপাশের গ্রামগুলো প্লাবিত হয়। এতে ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেন এবং অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধের দাবি জানান।
প্রশাসনের অভিযান ও ইউএনওর কঠোরতা:
গত ২৬ আগস্ট মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ ইসরাইল হোসেনের নির্দেশে শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ মহিবুল্লাহ আকনের নেতৃত্বে উপজেলার সিন্দুরখান ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। অভিযানে অর্পিত বালু মহালগুলোতে অভিযান চালিয়ে আনুমানিক ৫০০ ঘনফুট বালু জব্দ করা হয়। এ সময় সেনাবাহিনীর একটি টিমও সহযোগিতা করে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোঃ ইসলাম উদ্দিন বলেন, “অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে উপজেলা প্রশাসন কঠোর অবস্থানে রয়েছে। এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা অব্যাহত থাকবে।”
তিনি আরও জানান, সম্প্রতি সম্ভাব্য বালু উত্তোলনস্থলে লাল পতাকা টাঙানো ও বাঁশের ব্যারিকেড বসিয়ে ট্রাক চলাচল বন্ধ করা হয়েছিল। নদী, পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষা এবং কৃষিজমি সুরক্ষার স্বার্থে “বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০” মেনে চলার জন্য শ্রীমঙ্গলের জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
সাংবাদিকদের সোচ্চার ভূমিকা:
অবৈধ বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে সোচ্চার স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরাও। দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন জসিম তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, “মতিগঞ্জের বিলাস ছড়া থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে, এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।”
অন্যদিকে দৈনিক কালের কণ্ঠের মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি মোঃ সাইফুল ইসলাম প্রশাসনকে উদ্দেশ করে লিখেন, “বালু খেকোদের নিয়ে বালু ব্যবসা চালু করার জন্য তদবিরে প্রশাসনের দফতরে—কথিত সংবাদকর্মী।” যদিও তিনি সেই প্রভাবশালী সাংবাদিকের নাম প্রকাশ করেননি।
দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি:
শুধু পরিবেশ নয়, মানুষের জীবনও হুমকির মুখে পড়ছে। শ্রীমঙ্গলের ভূনবীর ইউনিয়নে অবৈধ বালুবাহী ট্রাকের ধাক্কায় তিনজন নিহত হওয়ার ঘটনা এখনও এলাকাবাসীর মনে দগদগে ক্ষত হয়ে আছে।
অন্যান্য উপজেলায় একই চিত্র:
কমলগঞ্জের ধলাই ও লাঘাটা নদী থেকে বালু উত্তোলনের কারণে বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন পাহাড়ি ছড়া থেকেও অবৈধভাবে বাল উত্তোলন করার ফলে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় হচ্ছে । কুলাউড়ায়ও ইজারা সীমা অতিক্রম করে বালু উত্তোলনের দায়ে এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজারকে জরিমানা করা হয়েছে।
জুড়ী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ড্রেজার দিয়ে নির্বিচারে বালু উত্তোলনে নদীভাঙন ও জমি ধ্বংসের প্রতিবাদে এলাকাবাসী মানববন্ধন করেছে। কিন্তু এসব আন্দোলনের পরও বালু লুট বন্ধ হয়নি।
সরকারি ইজারা বনাম অবৈধ ব্যবসা:
সরকারি হিসাবে মৌলভীবাজারে ৫২টি সিলিকা বালুর কোয়ারি আছে, যার মধ্যে ৩৩টির ইজারা অনুমোদিত। কিন্তু বাস্তবে ইজারার মেয়াদ শেষ হলেও অনেক ছড়া থেকে অবৈধভাবে বালু তোলা হচ্ছে। আদালতের নির্দেশ অমান্য করে বালু উত্তোলন চলায় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছে।
পরিবেশবাদীদের সতর্কবার্তা:
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) জানিয়েছে, আদালতের রায় অমান্য করে বালু উত্তোলন প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রমাণ। অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আক্তার বলেন,
“অবৈধ বালু উত্তোলন ঠেকানোর দায়িত্ব প্রশাসনের। যারা সুযোগ দিচ্ছেন, তারা আদালতের রায়কে অবমাননা করছেন।”
পরিবেশবাদীরা আরও সতর্ক করেছেন—এভাবে চলতে থাকলে ভোলাগঞ্জের মতো বালু-পাথর নিঃশেষ হবে, তখন কেবল আফসোস ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
উপসংহার:
মৌলভীবাজারের নদী ও ছড়াগুলো শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, এ অঞ্চলের জীবন-জীবিকারও অংশ। কিন্তু অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে পরিবেশ, কৃষিজমি, জীববৈচিত্র্য এবং মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে। প্রশাসনের অভিযান থাকলেও গডফাদারদের রেহাই—এটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে মৌলভীবাজারের নদী-ছড়া ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিলীন হবে বালু ব্যবসায়ীদের লোভে, আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।