প্রকাশিত : ০৭:৩৫
২৩ আগষ্ট ২০২৫
সংগ্রাম দত্ত: চা বাগান, হাওর আর বনাঞ্চলে ঘেরা পর্যটন নগরী শ্রীমঙ্গল। সবুজে ভরা এই শহরে প্রতিদিন সন্ধ্যা নামলেই এক অনন্য দৃশ্যের জন্ম হয়। বিদ্যুতের খুঁটিগুলো যেন পরিণত হয়েছে হাজারো চড়ুই পাখির নিরাপদ আশ্রয়ে। ব্যস্ততম চৌমুহনা হোক কিংবা শহরের অন্য মোড়— সূর্যাস্তের পর ঝাঁকে ঝাঁকে চড়ুই এসে বসে, আর তাদের কিচিরমিচির সুরে মুখর হয়ে ওঠে পুরো শহর।
গ্রামীণ স্মৃতির পাখি, শহুরে নতুন নিবাস:
কখনো গ্রামবাংলার কুঁড়েঘরের ছাদের কোনায় ছিল চড়ুই পাখির আস্তানা। কিন্তু আধুনিক শহরে ইট-কাঠ-পাথরের ভিড়ে সেই দৃশ্য আজ অনেকটাই বিলীন। পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাখিরাও খুঁজে নিয়েছে নতুন আশ্রয়— শহরের বিদ্যুতের খুঁটি, তার ও চৌমুহনা। আশ্চর্যের বিষয় হলো, মানুষও এদের বিরক্ত করছে না, ফলে শান্তিতে তারা বসতি গড়ছে।
ভোর থেকে সন্ধ্যার রুটিন:
প্রতিদিন ভোরে এই পাখিরা উড়ে যায় খাবারের খোঁজে দূর-দূরান্তে। সারাদিনের পরিশ্রম শেষে বিকেল ঘনিয়ে এলেই আবার ঝাঁকে ঝাঁকে ফিরে আসে শহরের খুঁটিতে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের তারগুলো ভরে ওঠে অসংখ্য চড়ুইয়ে, আর তাদের কণ্ঠস্বর চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। শহরবাসীর কাছে এটি এক অন্যরকম প্রাকৃতিক আনন্দ। অনেকেই মোবাইল ফোনে ছবি তুলে বা ভিডিও করে সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করেন এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।
স্থানীয় ও পরিবেশবিদদের অভিমত:
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গত তিন বছরের মধ্যে মৌলভীবাজার ও শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন চৌমুহনায় চড়ুইয়ের এমন বসতি তৈরি হয়েছে। প্রথমে সীমিত সংখ্যক পাখি থাকলেও ধীরে ধীরে ঝাঁক বড় হয়েছে এবং শহরের পূর্ব-পশ্চিম দুই দিকেই বিস্তৃত হয়েছে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, শ্রীমঙ্গলের কিছু এলাকায় গাছপালা সংরক্ষণ, কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণ কমে যাওয়া এবং নিরাপদ খুঁটি থাকার কারণে পাখিরা এ জায়গা বেছে নিয়েছে। চড়ুই শুধু শৈশবের স্মৃতি নয়, বরং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের এক জীবন্ত প্রতীক।
প্রকৃতির জন্য অপরিহার্য চড়ুই:
পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে, চড়ুই বছরে একাধিকবার প্রজনন করে, প্রতিবার ৪-৬টি ডিম দেয়। এর মধ্যে প্রায় ৬৫-৭০ শতাংশ ছানা বেঁচে থাকে। তারা ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে কৃষিজ ফসল, সবজি ও বনাঞ্চল রক্ষায় অমূল্য ভূমিকা রাখে। তবে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারে পাখিদের খাদ্য কমে যাওয়ায় তাদের টিকে থাকা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে।
সুরক্ষায় করণীয়:
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শহরে ছোট গাছপালা রক্ষা করা, পুরনো ঘরের ছাদ বা বারান্দার প্রান্তে ছোট ছোট বাসা তৈরির ব্যবস্থা করা গেলে চড়ুইসহ ক্ষুদ্র পাখিরা আবারও সমৃদ্ধভাবে বাঁচতে পারবে। এতে শুধু জীববৈচিত্র্যই নয়, শহরের পরিবেশও ভারসাম্যপূর্ণ থাকবে।
শ্রীমঙ্গলের বিদ্যুতের খুঁটিতে গড়ে ওঠা চড়ুই পাখির এ অভয়াশ্রম কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্যের এক অপার নিদর্শন নয়, বরং পরিবেশ ও মানুষের সহাবস্থানের এক বিরল দৃষ্টান্ত।