প্রকাশিত :  ০৮:৪১
১৯ আগষ্ট ২০২৫

বিলাস নদী: শ্রীমঙ্গলের হারানো নৌপথ ও ঐতিহ্যের গল্প

বিলাস নদী: শ্রীমঙ্গলের হারানো নৌপথ ও ঐতিহ্যের গল্প

সংগ্রাম দত্ত

সিলেট বিভাগের কসমোপলিটন টাউন ও চায়ের রাজ্য বলে দেশ-বিদেশে পরিচিত শ্রীমঙ্গল উপজেলার ঐতিহাসিক বিলাস নদী স্থানীয়ভাবে  বিলস নদী নামে পরিচিত, একসময় ছিল এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান নৌপথ ও বন্দর।

এই নদীর উৎপত্তি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উচ্চ পাহাড়ি এলাকা থেকে। সেখান থেকে এটি বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গল উপজেলার রাজঘাট ইউনিয়নে প্রবেশ করে এবং গোপলা নদীতে মিলিত হয়। দীর্ঘ সময়ের প্রাকৃতিক প্রবাহ ও জলধারার কারণে এটি স্থানীয় নদী হিসেবে বিকশিত হয়েছিল।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব

উনিশ শতক ও বিংশ শতকের শুরুর দিকে বিলাস নদী শুধু একটি জলপথ ছিল না—এটি ছিল প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু।

প্রশাসনিক ভূমিকা: ১৯১২ সালের পূর্বে শ্রীমঙ্গলের প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল মতিগঞ্জ, যা বিলাস নদীর তীরে অবস্থিত।

বাণিজ্য ও যোগাযোগ: নদীর ঢালু প্রাকৃতিক রুটের কারণে মাঝেমধ্যে বড় জাহাজ, লঞ্চ ও পালতোলা নৌকা কলকাতা পর্যন্ত যাতায়াত করত।

চা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র: চা শিল্পের প্রসারে নদীটি ছিল চা পাতার পরিবহন ও রপ্তানির অন্যতম প্রধান মাধ্যম।

অবক্ষয়ের সূচনা

বিলাস নদীর পতনের গল্প শুরু হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অবকাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে—

১৮৯৭ সালের ভূমিকম্প: ১২ জুলাই শিলিগুড়ি অঞ্চলে সংঘটিত ভয়াবহ ভূমিকম্প স্থানীয় ভূপ্রকৃতিকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করে। নদীর নাব্যতা মারাত্মকভাবে কমে যায় এবং নৌ চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়।

রেলপথের আগমন: ১৯০২ সালে শ্রীমঙ্গলে রেলস্টেশন স্থাপনের পর প্রশাসনিক কেন্দ্র মতিগঞ্জ থেকে শ্রীমঙ্গলে স্থানান্তরিত হয়। নদীপথের গুরুত্ব দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে।

বর্তমান অবস্থা

আজ বিলাস নদী অতীতের গৌরব হারিয়ে ধীরে ধীরে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে।

প্রবাহ সংকোচন: শুষ্ক মৌসুমে নদীর অনেকাংশ শুকিয়ে যায়।

দখল ও অনিয়ম: নদীর তীর অবৈধভাবে দখল করে কৃষিকাজ, মাটি কাটা, মাছ শিকার ও বালু উত্তোলনের মতো কর্মকাণ্ড চলছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।

পরিবেশগত প্রভাব: নদীর ধারা সংকুচিত হওয়ায় আশপাশের জীববৈচিত্র্য ও পানির প্রাপ্যতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

সংরক্ষণ ও পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা:

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিলাস নদীর পুনর্জীবনের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন—

উৎসস্থল থেকে গোপলা নদী পর্যন্ত পুনঃখনন ও নাব্যতা পুনরুদ্ধার,

অবৈধ দখল উচ্ছেদ,

মৌসুমি পানি সংরক্ষণের জন্য জলাধার নির্মাণ,

স্থানীয় জনগণ ও প্রশাসনের যৌথ অংশগ্রহণ।

উপসংহার: বিলাস নদী একসময় শ্রীমঙ্গলের প্রাণ ছিল—নৌপথ, বাণিজ্য ও প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অবকাঠামোগত পরিবর্তন এবং অবহেলার কারণে আজ এটি বিলীনপ্রায়।

যদি এখনই সংরক্ষণমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তবে শুধু পরিবেশ নয়, স্থানীয় অর্থনীতিও আবার প্রাণ ফিরে পেতে পারে।



Leave Your Comments




ভ্রমণ এর আরও খবর