প্রকাশিত :  ১০:১৭
১৬ আগষ্ট ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১০:৩৩
১৬ আগষ্ট ২০২৫

ঋণের দায়ে চার মৃতদেহ!

ঋণের দায়ে চার মৃতদেহ!

✍️ রেজুয়ান আহম্মেদ 

বামনশিকড় গ্রামটার নাম শুনলেই মনে হয়, কেমন নিরীহ, কেমন শেকড়ে বাঁধা কোনো জীবনযাপন। অথচ এই গ্রামেই এক দুপুরে পাওয়া গেল চারটি নিথর দেহ। বাতাসে তখনও গাঢ় ছিল কাঁচা ধানের গন্ধ, দুপুরের রোদে ধুকছিল মাঠের মাটি, অথচ মানুষের মুখে মুখে তখন শুধু একটাই নাম— মিনারুল।

মিনারুল ইসলাম—মোটে তিরিশ বছরের যুবক, তবে কপালের ভাঁজগুলো যেন কোনো বৃদ্ধের মতো। সংসারটাকে বাঁচাতে বাঁচাতে অকালেই শুকিয়ে গিয়েছিল তার চেহারা। লোকজন বলত— “মিনারুল ভালো মানুষ, কারও সঙ্গে ঝগড়া নেই।” কিন্তু ভালো মানুষ কি এভাবে সংসার গুটিয়ে নেয়?

সেদিন সকালে তাকে দেখা গিয়েছিল বাজারে। ছেঁড়া জামার পকেটে হাত গুঁজে মাথা নিচু করে হাঁটছিল। বাজারে যারা তাকে চিনত, তারা ডাক দিলেও সে সেদিকে ফিরল না। যেন চোখের ভেতর শুধু অন্ধকার জমাট বেঁধে ছিল।

ঋণের খাতাটা ফুঁড়ে ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছিল আতঙ্ক। মহাজনের চাপ, এনজিওর সাপ্তাহিক কিস্তি, বাজারে ধার—সব মিলিয়ে আর কোনো গলিপথ খোলা ছিল না।

মনিরা—তার স্ত্রী, কেবলই বলত,

—“তুমি একা বোঝা বইছো কেন? আমি কাজ করব, লোকের বাড়ি যাব।”

কিন্তু মিনারুল বলত,

—“না, আমার বউ লোকের বাড়ি কাজ করবে না। আমি মরব, কিন্তু তোর মাথায় চিরকালীন অপমান দেব না।”

সেই অপমান এড়াতে চাইতে চাইতেই আসলে সে মৃত্যুকেই বেছে নিল।

প্রথম চিরকুটে লিখল—

“আমি মিনারুল… আমরা চারজন আজ রাতে মারা যাব। এই মরার জন্য কারও কোনো দোষ নেই… প্রথমে আমার বউকে মেরেছি, তারপর আমার মাহিমকে, তারপর মিথিলাকে। এরপর আমি গলায় ফাঁস দিয়ে মরেছি। পুলিশ কাকে না কাকে ফাঁসিয়ে টাকা খাবে।”

দ্বিতীয় চিরকুটে তার বেদনা আরও নগ্ন হয়ে উঠল—

“আমি নিজ হাতে সবাইকে মারলাম… কারণ আমি একা মরে গেলে তারা কষ্ট ছাড়া কিছু পাবে না। আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে।”

এই দুটি চিরকুট যেন গ্রামের প্রতিটি দরজায় গিয়ে কড়া নেড়ে উঠল—দারিদ্র্য মানেই মৃত্যু, ঋণ মানেই শ্বাসরোধ।

মনিরা খাতুন বয়সে কেবল আটাশ। হাসলে তার দাঁতগুলো ঝকঝকে সাদা হয়ে বেরিয়ে আসত। বিয়ের সময় সবাই বলেছিল—এই মেয়েটি সংসারে আলো আনবে। সত্যিই এনেছিল। মাহিমকে কোলে নিয়ে বসলে সে গাইত—

“নদীর ওপারে চাঁদ উঠেছে, ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি গান শোনাবে…”

কিন্তু আলোও তো একদিন নিভে যায়। গত কয়েক মাস ধরে সংসারে রান্নার হাঁড়ি ঠিকমতো চড়ত না। চাল ছিল অল্প, ডাল পাতলা, শাকপাতা ধুয়ে ভেজে খাওয়া। প্রতিবেশী একবার বলেছিল—“মনিরা, আমার বাড়ি থেকে চাল নিয়ে যাও।”

সে হেসে মাথা নেড়েছিল—“না আপা, চাল চাই না। একদিন না খেলে মানুষ মরে যায় না।”

কিন্তু একদিন না খেলে হয়তো যায় না, প্রতিদিন না পেলে তো মরেই যায়!

মাহিম—চৌদ্দ বছরের কিশোর। ক্লাস সেভেনে পড়ে। পড়াশোনায় খারাপ ছিল না। বন্ধুরা ডাকত ফুটবল খেলতে। কিন্তু বাবা যদি টাকার জোগান দিতে না পারেন, স্কুলের ফি না মেটে, তাহলে আর বই-খাতা কেমন করে হবে?

ওর বুকের ভেতরে ছিল ছোট্ট এক স্বপ্ন—“আমি বড় হয়ে শিক্ষক হব।”

কিন্তু সেই স্বপ্নের চোখও সেদিন বন্ধ হয়ে গেল।

আর মিথিলা?

মাত্র তিন বছরের শিশু। লাল ফ্রক পরে গলগলিয়ে হাসত। তার বোঝার তো কিছুই ছিল না। কিন্তু মিনারুল বলেছিল—

“আমি একা গেলে ওরা কষ্ট পাবে।”

তিন বছরের শিশুর কষ্ট বোঝার জন্য কি তাকে মেরে ফেলতে হয়? নাকি দরিদ্র মানুষ এতটাই অসহায় হয়ে যায় যে, সন্তানদের জীবনও তার কাছে দায়ের মতো হয়ে ওঠে?

রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের বামনশিকড় গ্রামে যখন চারটি লাশ উদ্ধার হলো, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছিল। পুলিশের গাড়ি এলো, লোকে ছুটল, হাহাকার ভেসে গেল চারদিকে।

পুলিশ লাশ নামাল, চাদর চাপাল। কিন্তু চোখেমুখে ছিল উদাসীনতা—এমন মৃত্যুতে আর নতুনত্ব নেই। তারা যেন কেবল রুটিন মেনে কাগজপত্র পূরণ করছিল।

গ্রামবাসী বলল—

—“ঋণের দায়েই এই দশা।”

—“না, দোষ মহাজনের, এনজিওর।”

—“না না, দোষ সরকারের।”

কিন্তু আসলে দোষ কার?

এই প্রশ্নটাই রয়ে গেল খোলা আকাশে, ধানক্ষেতের বাতাসে, মাটির আঁকাবাঁকা পথে।

ময়নাতদন্তের জন্য দেহগুলো পাঠানো হলো রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেন্সিক বিভাগে। কিন্তু দেহ দেখে ডাক্তারও একসময় নিস্তব্ধ হয়ে গেল। তিন বছরের মিথিলার চোখ তখনও আধখোলা, যেন সে বলতে চাইছে—“কেন?”

এ প্রশ্নের জবাব কেউ দেয়নি, কেউ দেবে না।

গ্রামটিতে রাত নামল। কিন্তু সেই রাত আর সাধারণ রাত নয়। শোকের, আতঙ্কের, দারিদ্র্যের গাঢ় ছায়া নামল প্রতিটি উঠোনে।

কেউ কেউ বলল—

—“ঋণ মানেই ফাঁসের দড়ি।”

—“মানুষকে ঋণ দেওয়া হয়, কিন্তু শোধ করার সুযোগ দেওয়া হয় না।”

মিনারুলের মৃত্যু তাই শুধু এক ব্যক্তির নয়; তা যেন এক সমাজব্যবস্থার মৃত্যু।

এই কাহিনি তাই কেবল এক পরিবারের মৃত্যু নয়—এ এক সমগ্র সমাজের রক্তাক্ত প্রতিচ্ছবি।

যেখানে দারিদ্র্য মানে মানুষকে মানুষের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া, আর ঋণ মানে মানুষের গলায় অদৃশ্য দড়ি।

বামনশিকড়ের চারটি দেহ তাই আজও শুয়ে আছে মানুষের স্মৃতিতে—

চিরকুটে লেখা কথা যেন রক্তমাখা সতর্কবার্তা—

“আমরা মরলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে।”


Leave Your Comments




মত-বিশ্লেষণ এর আরও খবর