প্রকাশিত : ০৬:১২
১৬ আগষ্ট ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৬:২৯
১৬ আগষ্ট ২০২৫
বাংলাদেশের সমাজ ধর্মপ্রাণ। এখানে ধর্মীয় অনুশাসন ও বিশ্বাস মানুষের জীবনের অন্যতম ভিত্তি। কিন্তু সেই বিশ্বাসকেই পুঁজি করে প্রতারণার নতুন কৌশল গড়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, এক শ্রেণির মানুষ বাহ্যিক ধর্মীয় লেবাস পরে নিরীহ ও সহজ-সরল মানুষদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এরা নিজেদের ‘আল্লাহভীরু’ হিসেবে উপস্থাপন করে, অথচ অন্তরালে পরিকল্পনা সাজায়—কীভাবে বিশ্বাসকে ব্যবহার করে ব্যবসা চালানো যায়।
গালভরা দাড়ি, মাথায় টুপি, হাতে তসবিহ—এসব দেখে সাধারণ মানুষ সহজেই ধরে নেন তিনি একজন ধার্মিক ও সৎ ব্যক্তি। ধর্মীয় আবহে মোড়ানো এই লেবাস আসলে প্রতারণার ঢাল হয়ে উঠছে। একজন ধর্মপ্রাণ মানুষকে যেমন দেখানো হয়, তেমনই সাজসজ্জা করে তারা নিরীহ মানুষকে আস্থার ফাঁদে ফেলছে।
অভিযোগ রয়েছে, এরা কুরআন ও হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে মিষ্টি কথার জাল বোনে। অনেকেই ছোট ছোট দরবার বা ওয়াজ মাহফিলে বসে মানুষের আবেগ নাড়িয়ে দেন। আল্লাহর ভয়, আখেরাতের হিসাব, দান-খয়রাতের সওয়াব—এসব বিষয়ে সুন্দর বক্তৃতা সাজিয়ে মানুষকে বিশ্বাস করানো হয়। এরপর কেউ মসজিদ নির্মাণের অনুদান, কেউ এতিমখানার জন্য সাহায্য, কেউবা ‘বিশেষ দোয়া’র বিনিময়ে টাকা দাবি করে।
ঢাকার মিরপুরে সম্প্রতি এক প্রতারক চক্র ধরা পড়েছে, যারা "কুরআন শেখার দোয়া" নামে ভুয়া তসবিহ ও তাবিজ বিক্রি করে কয়েক মাসে প্রায় ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। একইভাবে চট্টগ্রামে এক ভণ্ড পীর ধরা পড়েন, যিনি দোয়া-পথ্য দিয়ে রোগ সারানোর দাবি করে প্রায় ৫০০ পরিবারকে সর্বস্বান্ত করেন।
এই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন মূলত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ধর্মপ্রাণ মানুষ। তাঁরা ধর্মীয় আবেগে সহজেই বিশ্বাস করে ফেলেন এবং ভেবে নেন—"এ কাজ করলে সওয়াব হবে।" অনেক সময় দেখা যায়, মাসিক অল্প আয়ের পরিবারও শেষ সম্বল থেকে টাকা দিয়ে দেয়। পরে যখন সত্য প্রকাশ পায়, তখন লজ্জা ও অপমানে অনেকে বিষয়টি প্রকাশ করতে চান না। বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে ধর্মের নামে প্রতারণার অভিযোগে ৭০০টিরও বেশি মামলা হয়েছে।
এ ধরনের প্রতারণা শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিই করছে না, বরং ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপরও আঘাত হানছে। মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে—কে প্রকৃত ধার্মিক আর কে ভণ্ড? একদিকে প্রতারণায় ক্ষতিগ্রস্তরা ধর্মের প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন, অন্যদিকে প্রকৃত আলেম-ওলামাদেরও প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে ব্যবসা করার কারণে ধর্মের পবিত্র ভাবমূর্তি কলুষিত হচ্ছে।
ধর্মীয় শিক্ষার আলোকে প্রতারণার নিন্দা
ইসলামে প্রতারণাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। হাদিসে এসেছে—
“যে ব্যক্তি আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।” (সহিহ মুসলিম)
অন্য এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
“সৎ ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গে থাকবে।” (তিরমিজি)
অতএব, ধর্মকে ব্যবসা বা প্রতারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা ইসলামের মৌলিক শিক্ষার পরিপন্থী। অথচ এই ভণ্ডরা সেই শিক্ষাকেই বিকৃত করে মানুষের সর্বনাশ করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফারুক আহমেদ বলেন, “ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে প্রতারণা সমাজে আস্থার সংকট তৈরি করছে। মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে—কারা প্রকৃত ধার্মিক আর কারা নয়। এটি দীর্ঘমেয়াদে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে।”
ধর্মীয় বিশ্লেষকরা বলছেন, সমাজে প্রকৃত ইসলামি শিক্ষার প্রচার বাড়াতে হবে। ইসলাম কখনো বাহ্যিক লেবাস নয়, বরং আচার-আচরণ ও সততার মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
করণীয়
১. সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি: মানুষকে বুঝতে হবে, বাহ্যিক সাজসজ্জা দেখে কারও প্রতি অন্ধ আস্থা রাখা উচিত নয়।
২. আইনের কঠোর প্রয়োগ: ধর্মের নামে প্রতারণাকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
৩. প্রকৃত আলেমদের ভূমিকা: ভণ্ডদের মুখোশ উন্মোচন করে মানুষকে সচেতন করতে হবে।
৪. গণমাধ্যমের দায়িত্ব: প্রতারণার কৌশল ও ঘটনার উদাহরণ তুলে ধরে মানুষকে সাবধান করতে হবে।
ধর্ম মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে জড়িত। এর পবিত্রতা ও সততার ওপর সমাজের স্থিতিশীলতা নির্ভর করে। কিন্তু যখন অসাধু ব্যক্তিরা ধর্মকে পুঁজি করে প্রতারণার ব্যবসা চালায়, তখন তা শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়, সমাজে আস্থার সংকটও তৈরি করে। তাই এ ধরনের অপকর্ম রোধে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র—সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। না হলে ভণ্ডদের প্রতারণায় নিরীহ মানুষ প্রতারিত হতে থাকবে, আর ধর্মের পবিত্রতা কলঙ্কিত হবে।