প্রকাশিত :  ০৬:১৯
১৫ আগষ্ট ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৬:৩৬
১৫ আগষ্ট ২০২৫

২০২৬ সালের নির্বাচন: সংস্কারের দাবিতে রাজনীতির দাবানল, অনিশ্চয়তার জালে গণতন্ত্র!

সম্পাদকীয় বিশ্লেষণ

২০২৬ সালের নির্বাচন: সংস্কারের দাবিতে রাজনীতির দাবানল, অনিশ্চয়তার জালে গণতন্ত্র!
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক সংবেদনশীল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা এসেছে, কিন্তু বড় দলগুলোর শর্তসাপেক্ষ অবস্থান পুরো প্রক্রিয়াকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানিয়েছেন—নির্বাচন নির্ধারিত সময়েই হবে। তবে এনসিপি, জাতীয় পার্টি, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান স্পষ্ট—সংস্কার ছাড়া তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না (যদিও বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণে উদগ্রীব, তবে তাদেরও কিছু শর্ত রয়েছে)। এই পরিস্থিতি জনমনে নতুন করে প্রশ্ন তুলছে—এই নির্বাচন কি সত্যিই অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হবে?
এনসিপি: সংস্কার ছাড়া নির্বাচন নয়
ন্যাশনাল কনসেনসাস পার্টি (এনসিপি) ঘোষণা দিয়েছে—তারা দেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও নির্বাচনী সংস্কার বাস্তবায়নের আগে নির্বাচনে অংশ নেবে না। তাদের দাবিগুলো হলো:
১. সম্পূর্ণ স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন,
২. দলীয় প্রভাবমুক্ত প্রশাসনিক কাঠামো,
৩. রাজনৈতিক সহিংসতার অবসান,
৪. সব দলের জন্য সমান প্রচারণার সুযোগ নিশ্চিতকরণ।
এনসিপির মতে, এসব সংস্কার বাস্তবায়িত না হলে ভোট কেবল আনুষ্ঠানিকতায় সীমিত থাকবে; জনগণের আস্থা অর্জন সম্ভব হবে না।
জাতীয় পার্টি: আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন নয়
জাতীয় পার্টির অবস্থান রাজনৈতিক অঙ্গনে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। তারা বলছে—আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেবে না। বিশ্লেষকদের মতে, এটি একদিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের বৈধতা রক্ষার প্রচেষ্টা, অন্যদিকে ক্ষমতার সমীকরণে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখার কৌশল। তবে এই শর্ত জনমনে বিভ্রান্তি বাড়াচ্ছে এবং অন্যান্য দলকেও কৌশলগত দ্বিধায় ফেলেছে।
বিএনপি: নির্বাচনের জন্য উদগ্রীব
দীর্ঘ আন্দোলন, অবরোধ ও রাজনৈতিক চাপের পর বিএনপি এখন নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী। তারা নির্বাচন দ্রুত আয়োজনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপ দিচ্ছে, তবে প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা ও নির্বাচন কমিশনের সংস্কার তাদের জন্যও অপরিহার্য শর্ত। রাজনৈতিক বাস্তবতা বিএনপিকে বুঝিয়ে দিয়েছে—এবারও নির্বাচন বয়কট করলে ভবিষ্যতে টিকে থাকা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।
জামায়াতে ইসলামী: সংস্কারের পুনরাবৃত্ত দাবি
জামায়াতে ইসলামীও ঘোষণা দিয়েছে—সংস্কার ছাড়া তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। এই দাবি তাদের রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবনের কৌশল হিসেবে দেখা হলেও, অতীত ইতিহাসের কারণে জনমনে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়ে গেছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও পূর্ববর্তী নির্বাচনের অভিজ্ঞতা
বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে বিতর্কিত অধ্যায়ের অভাব নেই, যা বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ:
১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি নির্বাচন: তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ ছাড়াই নির্বাচন আয়োজন করে। স্বল্প ভোটার উপস্থিতি ও আন্তর্জাতিক সমালোচনার প্রেক্ষাপটে কয়েক মাসের মধ্যেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
২০১৪ সালের নির্বাচন: বিএনপির বয়কট সত্ত্বেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা জয়ী হন। এর ফলে আন্তর্জাতিক মহলে বৈধতা সংকট এবং দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়।
২০১৮ সালের নির্বাচন: সব দল অংশ নিলেও ভোটের দিন ব্যাপক অনিয়ম, কারচুপি ও সহিংসতার অভিযোগ ওঠে। নির্বাচন-পূর্ব সময়ে বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও হয়রানির ঘটনাও আলোচিত হয়।
২০২৬ সালের প্রেক্ষাপটে এই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে—কিছু দল অংশ নিতে চাইছে, কিছু দল সংস্কার দাবি করছে, আর নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অর্থনৈতিক প্রভাব
আন্তর্জাতিক মহল ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করেছে—বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন তারা প্রত্যাশা করে। অন্যথায়:
বিদেশি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে,
বাণিজ্য চুক্তি ও রপ্তানি সুবিধায় শর্তারোপ হতে পারে,
বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য বিলম্বিত হতে পারে,
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সরাসরি অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিকে ব্যাহত করতে পারে।
ড. মুহাম্মদ ইউনুস: আস্থার বার্তা বনাম বাস্তব চ্যালেঞ্জ
আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত ড. ইউনুস ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের পরিষ্কার সময়সীমা দিয়েছেন। কিন্তু বড় দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়া এই উদ্যোগ ১৯৯৬ বা ২০১৪ সালের মতো রাজনৈতিক সংকট ডেকে আনতে পারে।
সমাধানের পথ: সমঝোতার রাজনীতি
সকল দলকে নিয়ে জরুরি সংলাপ, নির্বাচন-পূর্ব আংশিক সংস্কার বাস্তবায়ন, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মিশন নিশ্চিত করা এবং রাজনৈতিক সহিংসতার অবসান—এগুলোই হতে পারে উত্তরণের মূল উপায়। কেবল সমঝোতা ও আস্থার ভিত্তিতেই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ইতিহাসে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে।
২০২৬ সালের নির্বাচন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি মোড় পরিবর্তনের সুযোগ। কিন্তু দলীয় স্বার্থ, শর্তসাপেক্ষ রাজনীতি ও অনিশ্চয়তা এই সম্ভাবনাকে ব্যর্থতায় রূপান্তরিত করতে পারে। অতীতের ভুল পুনরাবৃত্তি এড়াতে এখনই সময়—সকল পক্ষকে জাতীয় স্বার্থে সংস্কার, সংলাপ ও আস্থার পথে এগিয়ে আসতে হবে।

Leave Your Comments




মত-বিশ্লেষণ এর আরও খবর