প্রকাশিত : ১৯:৪৭
১০ আগষ্ট ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ২১:০৮
১০ আগষ্ট ২০২৫
✍️ রেজুয়ান আহম্মেদ
একটি জাতি যখন তার গুণী সন্তানদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়, তখন সেই জাতির অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা। বাংলাদেশ, একটি সম্ভাবনাময় জাতি, যার মাটিতে জন্ম নিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন বিশ্বনাগরিক। তিনি শুধুমাত্র একজন অর্থনীতিবিদ বা সমাজসেবী নন; তিনি একটি দৃষ্টান্ত—মানবতার সেবায় নিবেদিত এক অদম্য চেতনা, যিনি ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইকে বিশ্বমঞ্চে একটি আদর্শে পরিণত করেছেন। তবুও, আমরা, বাংলাদেশি জাতি, তার এই অবদানকে যথাযথ মূল্য দিতে পারিনি। এটি আমাদের সমষ্টিগত ব্যর্থতা, আমাদের দূরদর্শিতার ঘাটতি, আমাদের নিজেদের প্রতি অবিচার।
২০০৬ সালে, যখন ড. ইউনূস এবং তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন, তখন বাংলাদেশের মাথা বিশ্ব দরবারে উঁচু হয়েছিল। তার ক্ষুদ্রঋণ মডেল বিশ্বের প্রান্তিক মানুষের জন্য আশার আলো জ্বালিয়েছিল। কিন্তু এই গৌরবের মুহূর্তে আমরা কী করেছি? তাকে সম্মান জানানোর পরিবর্তে তার বিরুদ্ধে মামলার পর মামলা, অপবাদের পর অপবাদ চাপিয়েছি। গত দেড় দশকে তিনি ১৭২টি মামলার সম্মুখীন হয়েছেন, যা অনেকের মতে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফল। এই অপমানের ইতিহাস আমাদের জাতীয় চরিত্রের একটি অন্ধকার অধ্যায়।
২০২৪ সালের আগস্টে, যখন ড. ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন তিনি একটি বিপর্যস্ত দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, যা একসময় উদ্বেগজনকভাবে নিম্নমুখী ছিল, তার নেতৃত্বে ৩০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে পৌঁছেছে। এটি কোনো সাধারণ কৃতিত্ব নয়; এটি একটি জাতির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের গল্প। এমনকি তার কূটনৈতিক দক্ষতার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের রপ্তানিপণ্যে ২০% শুল্ক নির্ধারিত হয়েছে—যা ভারতের ২৫% শুল্কের তুলনায় কম। এই সাফল্য বাংলাদেশের কূটনৈতিক দক্ষতার প্রমাণ, যার পেছনে রয়েছে ড. ইউনূসের অগ্রণী ভূমিকা।
বিশ্বের রাষ্ট্রনেতারা তার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বব্যাংক—সবাই তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতি নবআস্থা প্রকাশ করেছে। তার বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা এমন একটি সম্পদ, যা আমরা কখনোই পূর্ণাঙ্গভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। এটি আমাদের জাতীয় ব্যর্থতার একটি তিক্ত সত্য। যে মানুষটি বিশ্বজুড়ে সম্মানিত, তাকে আমরা নিজ মাতৃভূমিতে কেন সম্মান দিতে পারিনি? কেন আমরা তার দূরদর্শিতাকে জাতীয় উন্নয়নে সুপরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছি?
ড. ইউনূসের জীবন ও কর্ম আমাদের সামনে একটি আয়না উপস্থাপন করেছে। তিনি তার ‘থ্রি-জিরো মডেল’—দলীয় রাজনীতি মুক্ত, দুর্নীতি মুক্ত ও মানবাধিকার লঙ্ঘন মুক্ত সমাজ—দিয়ে দেখিয়েছেন কীভাবে একটি জাতি সুশাসন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারে। তিনি শুধু স্বপ্ন দেখাননি, বাস্তবায়নের রূপরেখাও দিয়েছেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। তিনি শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সুশাসন ও জলবায়ু পরিবর্তনের সহনশীলতাসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবুও আমাদের সমাজের একাংশ তার বিরুদ্ধে সমালোচনা ও কুৎসা রটনায় ব্যস্ত।
এই কুৎসা ও সমালোচনার সংস্কৃতি আমাদের জাতীয় চরিত্রের একটি দুর্বলতা। আমরা গুণীজনকে সম্মান দিতে শিখিনি, তাদের অবদানকে কাজে লাগাতে জানিনি। ড. ইউনূসের মতো বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব, যিনি ৮৪ বছর বয়সেও দুর্নিবার শক্তি নিয়ে দেশের জন্য কর্মে নিয়োজিত, তাকে আমরা কেন সংশয়ে দেখি? আমাদের এই সংকীর্ণতা পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের শিখতে হবে কীভাবে গুণী ব্যক্তিদের যোগ্যতাকে জাতীয় অমূল্য সম্পদে পরিণত করতে হয়।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে নবউদ্যমের প্রতীক। তার দৃষ্টিভঙ্গি, অভিজ্ঞতা ও বৈশ্বিক স্বীকৃতি—এগুলো আমাদের জন্য এক অনন্য সুযোগস্বরূপ। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে আমাদের সংকীর্ণ মানসিকতা পরিহার করা জরুরি। গুণীজনকে শ্রদ্ধা ও তাদের অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন করতে আমাদের শিখতে হবে। ড. ইউনূস আমাদের সামনে একটি স্বপ্ন উন্মোচন করেছেন—একটি দুর্নীতিমুক্ত, গণতান্ত্রিক, সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব শুধু তার একক নয়, আমাদের সবার।
আমরা যদি তাকে এখনও মূল্যায়ন করতে না শিখি, তবে এটি কেবল তার প্রতি আমাদের ব্যর্থতা নয়, বরং জাতীয় ব্যর্থতা হিসেবে ইতিহাসে অঙ্কিত হবে। এটাই সময় নিজেদেরকে প্রশ্ন করার—আমরা কি সত্যিই গুণীজনকে মূল্য দিতে সক্ষম? নাকি আমাদেরই সংকীর্ণতা আমাদের সম্ভাবনাকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করছে? ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই মৌলিক প্রশ্ন আমাদের সামনে উত্থাপন করেছেন। এবার প্রত্যুত্তরের দায়িত্ব আমাদের।