প্রকাশিত : ০৬:২৭
০৮ আগষ্ট ২০২৫
প্রাপক : খোদা তালা আর গোটা কওম
প্রেরক: করিম চাচা,
পেশা: রাস্তার চায়ওয়ালা,
বয়স: পঁচাশি পেরিয়ে,
ঠিকানা: গাজীপুর শহরের চান্দনা চৌরাস্তার ধারে
নজরানা: বিকেল বেলার লাইভ, রাতের লাশ — রাষ্ট্র যখন গুম, খোদাই একমাত্র গভীর!
প্রিয় খোদা,
কথা ফুরিয়েছে। চোখে পানি, বুকের ভেতর কান্নার পাথর চাপা। আমি করিম, গাজীপুর চান্দনা চৌরাস্তায় টিনের চায়ের দোকানওয়ালা। ত্রিশ বছর ধরে এখানে কাঁচের গ্লাসে চা ঢালি। শহরের ন্যাকা-প্যাকা, জুলুম-জবরদস্তির কত মুখোস দেখেছি। কিন্তু গত রাতের দৃশ্য এ বুড়ো হাড়ে শেল বিঁধে দিল।
এক সাহসী ছেলের রক্তে আমার দোকানের পাশের পিচঢালা পথ লাল হয়ে উঠল। নাম ছিল তুহিন। বিকেল বেলাই চাঁদাবাজদের ফাঁস করেছিল ফেসবুকে লাইভে। রাত না পোহাতেই গলার শিরা কেটে ফেলল ওকে। হাঁ, গলাকাটা! আমার দোকানের সামনে! লোকালয়ের মাঝখানে! শত লোকের চোখের সামনে!
হে মালিক, তুমি কোথায় লুকিয়েছিলে?
জানি তুমি সব দেখ। কিন্তু যারা রাষ্ট্র চালায় বলে গদিতে ঠেস দিয়েছে, ওই নাকাল সরকার—ওদের কি চোখ ছিল না? সিসি ক্যামেরা ঝুলছিল, ট্রাফিকের পুলিশ দাঁড়িয়েছিল, ফালতু হুইসেল বাজানো প্রশাসনও ছিল—তবু তুহিন বাঁচল না। তবু তার ঘর খালি হলো, ছেলেমেয়ে বাপ-হারা হলো।
আঁধারে দেখলাম—তুহিনের রক্ত পিচের ফাঁকে ফাঁকে জমাট বাঁধছে, আর কর্তারা তখনো 'তদন্ত' নামক পুতুল নাচাচ্ছে।
তদন্ত নয়, খোদার দরবারে ইনসাফ চাই।
রাষ্ট্রের কাছে কিছু চাই না। ওরা বালখিল্য। তুহিন লাইভ দিয়েও যদি বাঁচানো গেল না, তবে এ রাষ্ট্রের দাম কী?
ওরে কওম,
শোন এক বাক্য—তুহিনকে খবরের কাগজের শিরোনাম ভেবো না। সে ছিল আমাদের চোখের মণি। দেখিয়ে দিত—কে কোন গলিতে চাঁদা কাটে, কে ফুটপাত জবর দখল করে, কে গরিবের রক্ত চুষে। আজ সেই চোখ উপড়ে নিল। এখন আমরা অন্ধকারে হাতড়াই।
আমি করিম, লেখাপড়া জানি না। কিন্তু এটুকু বুঝি—সত্য বলার দায়ে মরতে হবে, এ নিয়ম উঠে গেলে, জাতির কবর রচনা হবে।
তুহিনকে খুন করা হয়নি—আমাদের বিবেককে গলাকাটা হয়েছে।
রাষ্ট্র চলে কেমনে, তা বুঝি না। আমি না মন্ত্রী, না সচিব, না পুলিশের দারোগা। শুধু জানি—যে রাষ্ট্র একজন সাচ্চা মানুষকেও বাঁচাতে পারল না, সে রাষ্ট্র মরার খাতায় নাম লেখাল। মানচিত্রে আঁকা কাগজের বাঘ মাত্র।
হে অন্তর্বর্তী শাসকগণ,
ওয়াদা করেছিলে—আইন-কানুন ঠিক রাখবে। সুবিচার ফিরাবে। সে সুবিচার কই? নিরাপত্তা কই? গাজীপুরের মতো রমরমা জায়গায় সাংবাদিকের গলাকাটা খুন প্রকাশ্যে! তাহলে তো দেশ নামক জাহাজ হাল ছাড়া!
তুহিন শুধু সাংবাদিক ছিল না—সে ছিল প্রতিবাদের হাতিয়ার। তার কলম চোখের মতো চোখা, হিম্মতের মতো ধারালো। আজ সেই কলম রক্তে ডুবল।
হে খোদা, আর নাই বলি। শুধু চোখ তুলে কহি—আমাদের রক্ষা কর। বিবেক ফিরিয়ে দাও। যারা সত্যের জিগির তোলে, তাদের ছায়া দাও।
ওরে ভাইসব,
একটা কথা শোন—তুহিনের মতো হিম্মতওয়ালাদের পাশে দাঁড়াও। আজ যদি না দাঁড়ালে, কাল তোর ভাই, তোর ছেলে, তোর বাপও 'রাতের লাশ' হবে।
তুহিনের রক্ত বৃথা যাবে না—এই চায়ের দোকানের টিনের চালে দাঁড়িয়ে বলছি, পঁচাশি বছরের করিম চাচা। সাক্ষী রইলাম, খোদার কসম—একদিন আসবে, যখন সত্য বলতে গলায় ছুরি লাগবে না।
দস্তখত:
তুহিনের রক্তে-রাঙা সন্ধ্যার সাক্ষী
এক ব্যর্থ রাষ্ট্রের ভাগ্যাহত প্রজা
করিম
(চান্দনা চৌরাস্তার এক পয়সার চা বিক্রি করা মানুষ)
এ চিঠি শুধু এক বুড়োর ফরিয়াদ নয়—গোটা জাতির বুক চিরে বের হওয়া চিৎকার। যারা পড়বে, ছড়িয়ে দিও। সত্যের ডাকে সাড়া দেওয়াই শহীদ তুহিনের আসল ইজ্জৎ।