প্রকাশিত :  ২০:১৫
০১ আগষ্ট ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ২০:৩২
০১ আগষ্ট ২০২৫

লভ্যাংশের নামে প্রতারণা নয়, চাই পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা ও সুবিচার!

লভ্যাংশের নামে প্রতারণা নয়, চাই পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা ও সুবিচার!

✍️ রেজুয়ান আহম্মেদ

স্বপ্ন অনেক সময় ভেঙে পড়ে সামান্য অসতর্কতায়, আবার কখনো বিশ্বাসঘাতকতায়। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের গল্পটাও অনেকটা তেমনই। এক সময় যা ছিল কোটি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির আশ্রয়স্থল, আজ তা যেন রূপ নিয়েছে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের এক অন্ধকার গহ্বরে।

বিশেষ করে, যারা অল্প কিছু সঞ্চয় নিয়ে জীবনের নিরাপত্তা খুঁজতে এসেছিলেন এই বাজারে—তাঁদের অনেকেই আজ নিঃস্ব।

এই বাজারে এখন রাজত্ব করছে কিছু বিশেষ শ্রেণির কোম্পানি, যাদের হাতে পুঁজিবাজার যেন একপ্রকার খেলনার মতো। বছরের শেষে ‘ইপিএস’ নামক এক চাকচিক্যময় সংখ্যা দেখিয়ে তারা বিনিয়োগকারীদের চোখে ধুলো দেয়। বোঝায়—এই বুঝি ভাগ্য খুলে যাবে! অথচ ডিভিডেন্ড ঘোষণার সময় দেখা যায়, তারা হয়তো ৫ কিংবা ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশের নামে দায় সারছে—তাও যদি দেয়!

তার চেয়েও বড় কষ্টের বিষয় হলো—কিছু কোম্পানি তো আবার ঘোষণা দিয়েও লভ্যাংশ দেয় না। এ ধরনের প্রতারণা যেন এখন পুঁজিবাজারে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এরা একদিকে নিজেদের আয় দেখায় আকাশচুম্বী, আর অন্যদিকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বোকা বানিয়ে ফাঁকা করে দেয় তাঁদের সঞ্চয়ের ঝুলি। বছরের শেষে কেবল আশ্বাস দিয়ে যায়, যার বাস্তবে কোনো মূল্য নেই। বিনিয়োগকারীরা কেবল ধৈর্য হারিয়ে চুপচাপ ক্ষয়ে যেতে থাকেন।

একজন মধ্যবিত্ত মানুষ, যিনি মাস শেষে খরচ বাঁচিয়ে কিছু সঞ্চয় করেন—তিনি আশা করেন ভবিষ্যতের একটু নিরাপত্তা, একটু নিশ্চিন্ত জীবন। যখন তিনি কোনো কোম্পানির ইপিএস ৫ বা ১০ টাকা দেখেন, তখন মনে করেন, অন্তত ১-২ টাকা তো লভ্যাংশ পাবেন। কিন্তু দিনশেষে তাঁর কপালে কিছুই জোটে না। সেই কোম্পানির পরিচালকরা তখন দামি গাড়িতে চড়েন, পাঁচতারা হোটেলে মিটিং করেন, সন্তানদের বিদেশে পড়াতে পাঠান—আর বিনিয়োগকারী বসে থাকেন নিজের ঠকে যাওয়ার হিসাব নিয়ে।

বিএসইসি, যাদের বিনিয়োগকারীদের ভরসাস্থল হওয়ার কথা, তারাও যেন আজ এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারছে না। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে জরিমানা হয়, নোটিশ যায়—কিন্তু এতে কি কোম্পানিগুলোর কিছু আসে যায়? বরং দিন দিন তারা আরও সাহসী হয়ে উঠছে। কারণ তারা জানে—এই দেশে শাস্তি বলে কিছু তেমন নেই।

প্রশ্ন হলো—এই একই নাটক কেন বারবার পুঁজিবাজারে চলে? কেন বারবার সাধারণ মানুষ প্রতারিত হন, আর যারা প্রতারণা করেন তারাই বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ান?

বিদেশে এমন নয়। উন্নত দেশগুলোতে কেউ যদি বিনিয়োগকারীদের ঠকায়, সরকার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়। প্রতিষ্ঠানটি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সৎ ও দক্ষ মানুষদের দিয়ে পরিচালিত করে পুনর্গঠন করে। আমাদের দেশেও এমন একটি কাঠামো তৈরি করা এখন সময়ের দাবি।

বিশেষ করে—

যেসব কোম্পানি একাধিকবার লভ্যাংশ ঘোষণা করেও দেয়নি,

ইপিএস বাড়িয়ে ভুয়া মুনাফার গল্প সাজিয়েছে,

বছরের পর বছর বিনিয়োগকারীদের কিছুই দেয়নি,

কিংবা আর্থিক প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা আনতে ব্যর্থ হয়েছে—

তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ জরুরি। এসব কোম্পানির মালিকানা সাময়িকভাবে বাজেয়াপ্ত করে একটি নিরপেক্ষ বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালনা করা উচিত। যেখানে থাকবেন সৎ, দক্ষ, নিরপেক্ষ অর্থনৈতিক প্রশাসক—যিনি দেশের স্বার্থকে নিজের স্বার্থের ঊর্ধ্বে রাখেন।

পুঁজিবাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে কিছু জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন:

১. লভ্যাংশ প্রদান বাধ্যতামূলক করতে হবে আইন করে:

নির্দিষ্ট পরিমাণ মুনাফা হলে কোম্পানিগুলোকে ন্যূনতম হারে হলেও লভ্যাংশ দিতে বাধ্য করতে হবে।

২. লভ্যাংশ না দিলে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে:

ঘোষণা দিয়ে না দিলে দায়ী পরিচালকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে—শুধু জরিমানা নয়, প্রয়োজনে ফৌজদারি মামলাও।

৩. অডিট সঠিক ও নিরপেক্ষভাবে করাতে হবে:

কোম্পানিগুলোর ব্যালান্সশিট যেন নিরপেক্ষ ও স্বাধীন অডিটের মাধ্যমে যাচাই হয়—বিএসইসির সরাসরি তত্ত্বাবধানে।

৪. বিনিয়োগকারী সুরক্ষা তহবিলকে আরও শক্তিশালী করতে হবে:

যাতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা প্রয়োজনে ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন।

৫. আইপিও বা রাইট শেয়ার ছাড়ার আগে কঠোর যাচাই-বাছাই করতে হবে:

অন্তত ৫ বছরের আর্থিক রেকর্ড ও প্রকৃত লাভ যাচাই করেই অনুমতি দেওয়া উচিত।

পুঁজিবাজারে যারা আসেন, তারা কেবল লাভের আশায় আসেন না—আসেন বিশ্বাস নিয়ে। বিশ্বাস থাকে, এই বাজার আমার সঞ্চয় রক্ষা করবে, ভবিষ্যৎ গড়তে সাহায্য করবে। এরা আমাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। তাদের ছাড়া শুধু কোম্পানিই নয়, গোটা অর্থনীতিই হোঁচট খাবে।

তাদের রক্ষা করা মানেই দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করা। এটা শুধু রাষ্ট্র বা বিএসইসির নয়—আমাদের সবার দায়িত্ব।

এই প্রতারণার সংস্কৃতি যতদিন চলবে, ততদিন বাজারে আস্থা ফিরবে না। যারা ইপিএস দেখিয়ে স্বপ্ন দেখায়, কিন্তু লভ্যাংশ দিতে চায় না—তাদের মুখোশ খুলে দিতেই হবে।

কঠোর আইন, প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ ও অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি—এসব কেবল ঘোষণায় নয়, বাস্তবেও দেখতে চান বিনিয়োগকারীরা।

সেদিনই পুঁজিবাজার আবার হয়ে উঠবে স্বপ্নের বাতিঘর—যেখানে কেউ ঠকবে না, কেউ প্রতারিত হবে না। বরং সাম্য, স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচারের আলোয় আলোকিত হয়ে আমাদের অর্থনীতি এগিয়ে যাবে সামনে।


Leave Your Comments




লভ্যাংশ ঘোষণা এর আরও খবর