প্রকাশিত : ১৯:৪৮
০১ জুলাই ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ২০:১৮
০১ জুলাই ২০২৫
✍️ রেজুয়ান আহম্মেদ
ঢাকার ব্যস্ততম একটি এলাকা—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন জনারণ্য ডাস চত্বর। সেখানে প্রতিদিন শত শত মানুষ হেঁটে যায়, বসে, দাঁড়ায়, প্রেম করে, প্রতিবাদ করে কিংবা কেবল নীরবতা চাষ করে। সেই জায়গাতেই আজ পড়ে ছিলেন এক রিকশাচালক। যাঁকে দেখে প্রথমে মনে হয়েছিল, হয়তো একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু না—ঘুম নয়, সেটি ছিল চিরঘুম।
একজন রিকশাচালকের এমন মৃত্যু আমাদের সমাজব্যবস্থার হৃদপিণ্ডে কাঁচি চালানোর মতোই। তিনি ছিলেন এক শ্রমিক, যিনি দিনমান প্যাডেল চালিয়ে নিজের ও পরিবারের আহার জোগাড় করতেন। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই যুদ্ধ ছিল তাঁর সঙ্গী। রোগে-শোকে ভরা শরীর নিয়েও তিনি থেমে যাননি—কারণ থেমে গেলে পেট চলবে না, ঘরে চুলো জ্বলবে না। আর এই যুদ্ধেই একদিন তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়লেন, সোজা হয়ে বসে পড়লেন রিকশার সিটে, চোখ দুটো বন্ধ করলেন—ঘুম নয়, এবার চিরতরে বিদায়।
এই শহর দেখে না, বোঝেও না—এই শহরের মানুষ কেবল নিজেদের প্রয়োজন নিয়ে ছুটছে। কেউ পাশ দিয়ে হেঁটে যায়, কেউ দেখে মনে করে ঘুমোচ্ছেন, কেউ আবার এক ঝলক তাকিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। কিন্তু এই শহরের হৃদয়ে যে পাথরের স্তর, তা ভাঙে না, গলে না।
এক সময়, দুই পথচারী যাঁরা আবার ফিরে আসেন সেই পথ ধরে, কৌতূহলবশে একটু গায়ে হাত রাখতেই অনুভব করেন—না, এই মানুষটি আর নেই। মৃতদেহ তখনো রিকশার সিটে বসা, মাথা সামান্য নিচু, শরীর নিস্তেজ, নিঃশ্বাসহীন।
কী অদ্ভুত আমাদের নাগরিক সভ্যতা! শহরের প্রাণকেন্দ্রে একজন জীবন্ত মানুষ মৃত্যুবরণ করলেন, অথচ কেউ বুঝল না। ব্যস্ততা আমাদের অন্ধ করে দেয়, আত্মকেন্দ্রিকতা আমাদের বিবেক হারায়, আর অভ্যাস আমাদের অনুভূতিহীন করে তোলে।
ছাত্রদলের নেত্রী মানসুরা আলম বিষয়টি ফেসবুকে শেয়ার না করলে হয়তো এই খবরটুকুও আলোচনার বাইরে থেকে যেত। তাঁর ভাষায়, “সবারই মনে হয়েছিল, উনি ঘুমোচ্ছেন। কিন্তু যিনি ঘুমোচ্ছেন বলে মনে হলো, তিনি আসলে আর ঘুম থেকে উঠবেন না।”
এই মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। এটি এক আত্মঘাতী সমাজের চিত্রপট। যেখানে দরিদ্র মানুষের মৃত্যু যেন ‘ঘুমের মতো’ নিস্পৃহ। সংবাদমাধ্যমগুলোও হয়তো এই খবরটিকে একপাশে সরিয়ে রেখে অন্য খবরে মনোযোগ দেবে—কারণ এটি "ব্রেকিং নিউজ" নয়, "মানুষের মৃত্যুসংখ্যা" বাড়াবে না।
কিন্তু এই মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, আমরা কতটা পাথর হয়ে গেছি। আমাদের শহর কংক্রিটের, আমাদের হৃদয়ও তেমনি। একজন মানুষ মারা গেলেন রাস্তায়, রিকশার সিটে বসা অবস্থায়—কেউ পাশে বসে একটু কথা বললেন না, কেউ জিজ্ঞেস করলেন না, “ভাই, ঠিক আছেন তো?”
এই যে চিরঘুম, এটি কোনো শান্তির ঘুম নয়। এটি নিদারুণ অবহেলার, এক গভীর শ্রান্তির মৃত্যুদৃশ্য। যে মৃত্যু আমাদের জীবনের অর্থহীনতা ও শহরের অমানবিক কাঠামোর নগ্ন চিত্র হয়ে দাঁড়ায়। রিকশাচালকের নাম এখনো অজানা। হয়তো কেউ খোঁজ নেবে না, হয়তো কোনো গরিব গ্রামের কোণে এক বৃদ্ধা মা তাঁর ছেলেকে হারিয়ে হাহাকার করবেন—কিন্তু শহর টসকাবে না।
পুলিশ এসেছে, প্রক্টরিয়াল বডি এসেছে—আমলাতান্ত্রিক আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। একটি নাম, একটি ঠিকানা খোঁজার চেষ্টা চলছে। কিন্তু সেই নাম যে এক জীবনের সংগ্রামের ইতিহাস বহন করে, সেই ইতিহাস জানতে চাওয়ার সময় কি কারও আছে?
রিকশাচালকেরা প্রতিদিন শহরের পথে মানুষের গতি বহন করেন। তারা শহরটিকে জীবন্ত রাখেন, দমের মতো শহরজুড়ে ছড়িয়ে থাকেন। অথচ তারা থাকে প্রান্তে, তাদের কষ্টের গল্প আমাদের কানে পৌঁছায় না। তারা মরলেও আমাদের খবর হয় না—যতক্ষণ না কেউ তা সামাজিক মাধ্যমে তুলে ধরেন।
একটা সমাজ কতটা পচে গেলে রাস্তায় বসে থাকা মৃতদেহকে ঘুমন্ত মনে হয়? আমরা কতটা নিষ্ঠুর হলে একটি মৃত্যুকেও চোখ এড়িয়ে যেতে পারি?
এই রিকশাচালক যেন গোটা সমাজব্যবস্থার সামনে এক চূড়ান্ত প্রশ্নচিহ্ন হয়ে রইলেন—কী মূল্য আছে একজন প্রান্তিক শ্রমজীবীর জীবনের? তাঁর ঘাম, ক্লান্তি, নিঃশ্বাস, দুঃখ—সবকিছু কি কেবল শহরের চাকার নিচে পিষ্ট হবার জন্য?
এই মৃত্যু যেন এক নীরব চিৎকার—যেখানে শহরের প্রতিটি রাস্তাই সাক্ষী হয়ে থাকে, আর আমরা কেবল পথচারী হয়ে থাকি।
আজ যে রিকশাচালক আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, তিনি হয়তো কোনোদিন নাম করবেন না ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু তাঁর এই নিঃসঙ্গ মৃত্যু একদিন আমাদের গলার কাঁটা হয়ে ফিরে আসবে। যখন আমরা বুঝব—মানুষের মতো মরতে পারাও এক সামাজিক অধিকার, এবং তা থেকে বঞ্চিত হওয়া আমাদের সভ্যতার চরম ব্যর্থতা।
এই শহরে হাজারো মানুষ প্রতিদিন ঘুমায়—কেউ নিজের ঘরে, কেউ ফুটপাতে, কেউ আবার রিকশার সিটে। কিন্তু কেউ যদি ঘুম থেকে আর না জাগে, সেটা কি আমাদের দায়িত্ব নয় তা বুঝে নেওয়ার?
এই রিকশাচালকের মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল—আমরা কেবল শরীর নিয়ে বেঁচে আছি, হৃদয় দিয়ে নয়।