প্রকাশিত :  ২০:১০
২৫ জুন ২০২৫

শরীরের ভাড়া!

বর্ষার ধূসর আকাশের নিচে ধানখেতের আল ধরে হাঁটছে রেহানা। তার পায়ে কাদা লেগে আছে, হাতে একটা ছেঁড়া প্লাস্টিকের ব্যাগ। ব্যাগের ভেতরে কয়েকটা মলিন কাপড়, একটা পুরনো মোবাইল ফোন—যার স্ক্রিনে ফাটল ধরেছে—আর একটা ছোট্ট ডায়েরি, যেখানে সে কখনো কিছু লেখে না, তবু সঙ্গে রাখে। রেহানার বয়স ত্রিশ ছুঁইছুঁই, কিন্তু কপালের ভাঁজ আর চোখের নিচের কালি তাকে আরও বয়স্ক দেখায়। তার চোখে একটা অস্থির দৃষ্টি, যেন কিছু খুঁজছে, কিছু হারিয়েছে।

গ্রামের মানুষ তাকে দেখে। কেউ ফিসফিস করে, কেউ মুখ ঘুরিয়ে নেয়। “ওই দেখ, রেহানা। শহরে গিয়ে কী করল কে জানে!” “আলমের বউ না? ওরা তো ঢাকায় থাকে এখন।” “শুনেছি, ও নাকি পেট বেচেছে।” এসব কথা রেহানার কানে পৌঁছায়, কিন্তু সে চুপ করে। তার মনের ভেতরে একটা দেওয়াল তৈরি হয়ে গেছে, যেখানে এই কথাগুলো ধাক্কা খেয়ে ফিরে যায়।

দুই বছর আগেও রেহানা ছিল বাগেরহাটের কোনারপুর গ্রামের সাধারণ এক গৃহবধূ। স্বামী আলম মাছ ধরত। তাদের একমাত্র মেয়ে ফাতেমা তখন পাঁচ বছরের। জীবন ছিল কষ্টের, তবু ছিল নিজস্ব। একটা ঝড় তাদের সব কেড়ে নিল। বঙ্গোপসাগরের তীরে তাদের কুঁড়েঘর ভেসে গেল, আলমের জাল আর নৌকা হারিয়ে গেল। তারপর এল ঋণের বোঝা। গ্রামের মহাজন কালাম মিয়ার কাছ থেকে ধার নিয়ে তারা ঢাকায় পাড়ি জমাল। আলম রিকশা চালাতে শুরু করল, আর রেহানা বাসাবাড়িতে কাজ করল। কিন্তু শহরের জীবন তাদের গিলে খেতে লাগল। ফাতেমার জ্বর হলে ডাক্তারের ফি, ওষুধের দাম—সব মিলিয়ে তাদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।

ঢাকার মিরপুরের একটা বস্তিতে তাদের ছোট্ট একটা ঘর। টিনের চালের নিচে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে, মেঝেতে কাদা জমে। আলম দিনরাত রিকশা চালায়, তবু টাকা জমে না। রেহানা একটা বড় বাসায় কাজ করে, যেখানে মালকিন রুমানা বেগম তাকে মাঝে মাঝে পুরনো কাপড় দেন। ফাতেমা স্থানীয় একটা ফ্রি স্কুলে পড়ে, কিন্তু তার বইয়ের খরচ, পেন্সিলের দাম—এসব যেন তাদের পিছু ছাড়ে না। কালাম মিয়ার ঋণের সুদ বাড়তে থাকে। ফোন আসে, “আলম, টাকা কবে দিবা? তোমার বউয়ের গয়না বন্ধক রেখেছিলে, তাও তো শেষ।” আলম চুপ করে থাকে, তার চোখে নিঃশব্দ ক্রোধ।

একদিন রুমানা বেগম রেহানাকে ডেকে বলেন, “রেহানা, তুমি কি একটা বড় কাজ করতে পারবে? অনেক টাকা পাবে। তবে মন শক্ত রাখতে হবে।” রেহানা তখন অবাক। কী কাজ? রুমানা বেগম তাকে বোঝালেন, তাদের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়, শহরের ধনী এক দম্পতি, নাজিয়া আর ফারুক, সন্তানের জন্য মুখিয়ে আছে। নাজিয়ার গর্ভে সন্তান ধরে না, বহু চিকিৎসার পরও কিছু হয়নি। তাই তারা একজন সারোগেট মা খুঁজছে—যে তাদের জন্য সন্তান জন্ম দেবে। বিনিময়ে রেহানা পাবে পাঁচ লাখ টাকা।

পাঁচ লাখ টাকা। রেহানার কাছে এটা যেন স্বপ্নের মতো। এই টাকা দিয়ে সে ফাতেমার ভবিষ্যৎ গড়তে পারবে, আলমের জন্য একটা দোকান কিনতে পারবে, গ্রামে ফিরে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবে। কিন্তু তার মনের ভেতরে খচখচ করছিল। এ কি ঠিক? নিজের গর্ভে পরের সন্তান বহন করা, সন্তান জন্ম দেওয়া, তারপর হাতে টাকা নিয়ে চলে আসা—এটা কি মানুষের কাজ? সে আলমের সঙ্গে কথা বলতে গেল। আলম রেগে গিয়ে বলল, “তোর পেটে আমার মেয়ে এসেছে। এখন তুই পরের জন্য এই নোংরা কাজ করবি? আমি রিকশা চালিয়ে যা পাই, তাতেই চলব।” রেহানা চুপ করে রইল। কিন্তু তার মনে হলো, আলম জানে না, রিকশার টাকায় তাদের ঋণ শোধ হবে না। ফাতেমার স্কুলের ফি, ওষুধ, খাবার—সব কিছু যেন তাদের গলা টিপে ধরে।

রেহানা রাজি হলো। রুমানা বেগম তাকে ঢাকার একটা বড় হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। সেখানে তার শরীর পরীক্ষা করা হলো। ডাক্তাররা বললেন, তার শরীর সুস্থ, সন্তান ধারণের জন্য উপযুক্ত। নাজিয়া আর ফারুক, ধনী দম্পতি, রেহানার সঙ্গে দেখা করলেন। নাজিয়া তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। “তুমি আমাদের জন্য যা করছ, তা আমরা কোনোদিন ভুলব না।” ফারুক শান্ত গলায় বললেন, “সব খরচ আমরা দেব। তুমি শুধু সুস্থ থেকো।” রেহানা মাথা নাড়ল, কিন্তু তার মনের ভেতরে অদ্ভুত শূন্যতা জাগল।

প্রক্রিয়া শুরু হলো। হাসপাতালে কয়েকটি জটিল চিকিৎসার পর রেহানার গর্ভে প্রাণ বাড়তে শুরু করল। প্রথম আল্ট্রাসাউন্ডে যখন সে হৃদস্পন্দন শুনল, তার চোখে জল এল। এই প্রাণ তার নয়, তবু তার শরীরেরই অংশ। মাস গড়াল। রেহানাকে শহরের একটা ছোট ফ্ল্যাটে রাখা হলো, যেখানে নাজিয়া নিয়মিত তাকে দেখতে আসতেন। তারা রেহানার জন্য ফল, দুধ, ভালো খাবার আনতেন। কিন্তু রেহানা লক্ষ্য করল, নাজিয়ার চোখে অদ্ভুত দ্বিধা। যেন সে ভয় পায়, রেহানার এই সন্তানের প্রতি মায়া পড়ে যাবে।

ফাতেমাকে দেখতে মাঝে মাঝে গ্রামে ফিরে গেলে ফাতেমা জিজ্ঞেস করত, “আম্মা, তোমার পেট বড় হয়ে গেছে। আমার ভাই আসবে?” রেহানার বুক ধক করে উঠত। সে কী জবাব দেবে? শুধু মেয়েকে জড়িয়ে ধরত। আলম আর কথা বলত না। সে রিকশা চালাত, রাতে ফিরে এসে চুপচাপ শুয়ে থাকত। গ্রামের মানুষ ফিসফিস করত। “রেহানা নাকি শহরে গিয়ে পেট বেচছে।” “এটা কি মানুষের কাজ?” “আলমের পুরুষত্ব নেই, তাই বউয়ের শরীর বিক্রি করছে।” এসব কথা রেহানার কানে আসত। সে চুপ করে থাকত। তার মনে হতো, এই কথাগুলো তার শরীরে ছুরির মতো আঘাত করে, কিন্তু সে আর কাঁদতে পারে না।

নাজিয়া তাকে নিয়মিত হাসপাতালে নিয়ে যেতেন। ডাক্তাররা বলতেন, “সব ঠিক আছে। শিশু সুস্থ।” নাজিয়া হাসতেন, কিন্তু তার হাসিতে অস্বস্তি ছিল। একদিন তিনি রেহানাকে বললেন, “তুমি বেশি ভাবছো না তো? এটা আমাদের সন্তান। তুমি শুধু আমাদের জন্য এটা করছ।” রেহানা মাথা নাড়ল, কিন্তু তার মনে হলো, নাজিয়া তার চোখে ভয় দেখছে। নাজিয়া বোধহয় বুঝে গেছেন, রেহানার মনে এই সন্তানের প্রতি মায়া জন্মে গেছে।

মাস নয়ে পৌঁছাল। রেহানার শরীর ভারী হয়ে গেছে। সে আর আগের মতো দ্রুত হাঁটতে পারে না। তার পিঠে ব্যথা, পায়ে ফোলাভাব। নাজিয়া আর ফারুক তাকে নিয়মিত হাসপাতালে নিয়ে যান। ডাক্তাররা বলেন, সব ঠিক আছে। কিন্তু রেহানার মন ঠিক নেই। সে রাতে ঘুমোতে পারে না। তার পেটে যে প্রাণ বাড়ছে, তার সঙ্গে অদ্ভুত বন্ধন তৈরি হয়ে গেছে। সে যখন পেটে হাত রাখে, শিশুটি নড়ে। সে জানে, এই শিশু তার নয়। তবু তার চোখে জল আসে।

একদিন রাতে, ফ্ল্যাটের ছোট্ট ঘরে, সে নিজের ডায়েরিটা খুলল। কিছু লিখতে চাইল, কিন্তু কলম হাতে নিয়ে কিছুই লিখতে পারল না। তার মনে হলো, তার ভেতরের কথাগুলো কোনো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। সে ফাতেমার কথা ভাবল। ফাতেমার জন্যই সে এই কাজ করছে। এই টাকা দিয়ে ফাতেমার ভবিষ্যৎ গড়বে। কিন্তু পেটের শিশুটির নড়াচড়া তাকে বারবার ডাকে। সে নিজেকে বোঝায়, “এটা আমার নয়। আমি শুধু একটা কাজ করছি।” তবু তার মন মানে না।

একদিন নাজিয়া এসে বললেন, “রেহানা, তুমি কি ঠিক আছো? তুমি বেশি ভাবছো। এটা আমাদের সন্তান। তুমি শুধু আমাদের জন্য এটা করছ।” রেহানা মাথা নাড়ল, কিন্তু তার মনে হলো, নাজিয়া তার চোখে ভয় পাচ্ছে। নাজিয়া বোধহয় বুঝে গেছেন, রেহানার মনে এই সন্তানের প্রতি মায়া জন্মে গেছে। রেহানা নিজেকে বলল, “আমি এই মায়া ত্যাগ করব। আমার ফাতেমা আছে। আমার সংসার আছে।” কিন্তু তার হৃদয় যেন তার কথা শুনল না।

গ্রামে ফিরে গেলে ফাতেমা তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আম্মা, তুমি এত দিন কোথায় ছিলে? আমার ভাই কবে আসবে?” রেহানার গলা বুজে এল। সে বলল, “ফাতেমা, তুমি আমার একমাত্র। তোমার জন্যই আমি সব করছি।” কিন্তু ফাতেমার নিষ্পাপ চোখ তার হৃদয়ে ছুরি চালাল। আলম তাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিল। সে বলল, “তোর এই কাজ আমার পছন্দ না। তুই যা করছিস, তা আমাদের সংসারে কলঙ্ক ডেকে আনবে।” রেহানা কিছু বলল না। তার মনে হলো, আলমের ক্রোধ তার নিজের অসহায়ত্বের প্রতিফলন।

বর্ষার এক রাতে, হাসপাতালের ঠান্ডা ঘরে, রেহানা এক কন্যা সন্তান জন্ম দিল। শিশুটির কান্না যেন তার হৃদয় ছিঁড়ে ফেলল। নার্স শিশুটিকে পরিষ্কার করে নাজিয়ার হাতে দিল। নাজিয়া শিশুটিকে কোলে নিয়ে কাঁদলেন। তার চোখে আনন্দ, কিন্তু রেহানার দিকে তাকালেন না। ফারুক এসে একটা খাম রেহানার হাতে দিয়ে বললেন, “ধন্যবাদ, রেহানা। তুমি আমাদের জীবন পূর্ণ করেছ।” খামে পাঁচ লাখ টাকা। রেহানা খামটা নিল, কিন্তু তার হাত কাঁপছিল।

হাসপাতালে শিশুটিকে তার কোলে দেওয়া হয়নি। নাজিয়া বলেছিলেন, “এটা আমাদের সন্তান। তুমি শুধু জন্ম দিয়েছ।” রেহানা মাথা নাড়ল, কিন্তু তার বুকের ভেতরে ঝড় উঠল। সে শিশুটির মুখ দেখতে চেয়েছিল, কিন্তু দ্রুত তাকে নিয়ে যাওয়া হলো। রেহানার চোখে জল জমল, কিন্তু সে কাঁদল না। তার মনে হলো, তার শরীরের একটা অংশ ছিঁড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে রেহানা বাড়ি ফিরল। ফাতেমা তাকে জড়িয়ে ধরল। “আম্মা, তুমি এত দিন কোথায় ছিলে?” রেহানা কিছু বলতে পারল না। সে ফাতেমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল। আলম তাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিল। রেহানা টাকার খামটা আলমের হাতে দিল। আলম খামটা ছুঁড়ে ফেলে বলল, “এই টাকায় আমার সংসার চলবে না। তুই আমার সম্মান নষ্ট করেছিস।” রেহানা চুপ করে রইল। তার মনে হলো, আলমের কথাগুলো তার নিজের অপরাধবোধের প্রতিধ্বনি।

মাস কাটল। রেহানা টাকা দিয়ে গ্রামে ফিরল। তারা কালাম মিয়ার ঋণ শোধ করল, ফাতেমাকে ভালো একটা স্কুলে ভর্তি করল। আলম ছোট একটা দোকান খুলল। বাহিরে সব ঠিক মনে হলো, কিন্তু রেহানার মন শান্ত হলো না। সে প্রায়ই ধানখেতের আল ধরে হাঁটত। গ্রামের মানুষ তাকে দেখত। কেউ ফিসফিস করত, কেউ মুখ ঘুরিয়ে নিত। “ওই দেখ, রেহানা। পেট বেচে টাকা কামিয়েছে।” “এটা কি মানুষের কাজ?” রেহানা চুপ করে থাকত। তার মনে হতো, এই কথাগুলো তার শরীরে ছুরির মতো আঘাত করে, কিন্তু সে আর কাঁদতে পারে না।

একদিন সে শুনল, নাজিয়া আর ফারুক শিশুটিকে নিয়ে বিদেশ চলে গেছে। তার মনে হলো, তার শরীরের একটা অংশ ছিঁড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সে ফাতেমাকে কোলে নিয়ে কাঁদল। ফাতেমা জিজ্ঞেস করল, “আম্মা, তুমি কাঁদছো কেন?” রেহানা কিছু বলতে পারল না। তার মনে হলো, তার কান্নার কোনো ভাষা নেই।

রেহানা হাঁটত। বর্ষার ধূসর আকাশের নিচে ধানখেতের আল ধরে। তার পায়ে কাদা, হাতে ছেঁড়া ব্যাগ। তার চোখে শূন্য দৃষ্টি। যেন কিছু খুঁজছে, কিছু হারিয়েছে। রাতে সে স্বপ্ন দেখত—একটা শিশু তার দিকে হাত বাড়িয়ে কাঁদছে। সে কোলে নিতে গেলে শিশুটি হাওয়া হয়ে যায়।

এক বছর পর, এক বর্ষার দিনে, রেহানা ধানখেতের আল ধরে হাঁটছিল। হঠাৎ তার পায়ের নিচে কাদায় পা পিছলে গেল। সে পড়ে গেল। তার হাতের ব্যাগটা ছিটকে পড়ল। ডায়েরিটা খুলে গেল। সে উঠে ডায়েরিটা তুলল। তার মনে হলো, এই ডায়েরিতে তার জীবনের শূন্যতা লেখা আছে। সে ডায়েরিটা খুলে একটা লাইন লিখল: “আমি আমার শরীর বেচি নি, আমি আমার হৃদয় হারিয়েছি।”


Leave Your Comments




সাহিত্য এর আরও খবর