প্রকাশিত : ১৬:৪৫
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
রেজুয়ান আহম্মেদ
নয়া মিয়া রোজ ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সাইকেলের লোহার কাঁধে ভর দিয়ে বেরিয়ে পড়েন। পিঠে ডালি, হাতে কোদাল। দিনের আলো ফোটার আগেই গঙ্গাচড়ার ধামুর থেকে দশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে হয় রংপুর শহরের ধাপ শিমুলবাগ শ্রমের হাটে। নয়া মিয়ার এই রুটিনটা চলে আসছে অনেক বছর ধরে, কিন্তু এ বছরের আশ্বিন মাস যেন তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় নিয়ে এসেছে।
গ্রামের খেতে কাজ থাকে না আশ্বিনে। জমির ফসলগুলো মাঠে পড়ে, সময়ের অপেক্ষায়। খেতের মালিকরা কাজ বন্ধ রেখেছেন, মাটি শুষ্ক হয়ে আছে। এই সময় শহরে গিয়ে কাজ খুঁজতে হয়। কিন্তু এবার শহরও যেন হাত গুটিয়ে বসেছে। বিল্ডিংয়ের কাজ নেই বললেই চলে। মানুষেরও কাজের চাহিদা কমে গেছে। নয়া মিয়া প্রতিদিনই সাইকেলে চড়ে শহরে আসেন, শ্রমের হাটে বসে থাকেন, কাজের অপেক্ষা করেন। কিন্তু দিন যায়, কাজ আসে না।
নয়া মিয়া যখন ধাপ শিমুলবাগের শ্রমের হাটে পৌঁছান, তখনো শহর ঠিক করে ঘুম থেকে জাগেনি। তবে শ্রমিকদের মাঝে অস্থিরতা লেগে থাকে। গুটি কয়েকজন ভাগ্যবান হয়তো কিছু কাজ পেয়ে যান, বাকিদের দীর্ঘ অপেক্ষা। নয়া মিয়া অপেক্ষা করেন, কিন্তু প্রতিদিন অপেক্ষার ঘন্টাগুলো আর্তনাদ করে কেটে যায়। কাজ নেই, ভরপেট খাওয়ার সামর্থ্য নেই, তবুও ফিরে যেতে হয়। আজ নয়া মিয়া ভেবে বসে আছেন, "আজ কি কিছু হবে? নাকি আবার খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হবে?"
তার মনে ভেসে ওঠে বাড়ির দৃশ্য। স্ত্রী, দুই সন্তান। তাদের মুখে খাবারের অভাবের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বড় মেয়ে স্কুলে যেতে চায়, কিন্তু চেহারায় এক ধরনের অনিশ্চয়তা ফুটে উঠেছে। ছোট ছেলেটা স্কুলের ড্রেসটা ময়লা করে ফেলেছে, কিন্তু ধোয়ার জন্য সাবান কেনার টাকাও নেই।
কখনো কাজ পেলে, তা দিয়ে দুই-তিন দিনের খাবার হয় না। এনামুল হকের মতো আরেক শ্রমিক, যার গল্পটাও প্রায় একই। এনামুলের দুই সন্তানের মধ্যে মেয়ে বিয়ে হয়ে গেছে, কিন্তু ছেলে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। পরীক্ষার ফি দিতে হবে, কিন্তু হাতে টাকাও নেই। সেও প্রতিদিন নয়া মিয়ার সঙ্গে শ্রমের হাটে আসে। "গত সাত দিনে মাত্র দুই দিন কাজ জুটছে," বলে এনামুল। মুখে হতাশার ছাপ, "আজ যে চাউল কিনমো, সেই টাকাও নাই।"
এনামুলের এই কথা শুনে নয়া মিয়া এক মুহূর্ত থমকে গেলেন। এই কথাগুলো যেন তার নিজের জীবনের প্রতিধ্বনি। একদিন কাজ জোটে তো, পরের দিন খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হয়। তবে নয়া মিয়া হাল ছাড়তে রাজি নন। তার মনে এক অদ্ভুত শক্তি, যা তাকে প্রতিদিন এই হাটে টেনে আনে। হয়তো কাজের আশায়, কিংবা শুধু এক ধরনের অভ্যাসে।
আজকের দিনটাও খুব আলাদা নয়। হাটে বসে থাকা লোকগুলো চুপচাপ, কারো মুখে কোনো আলাপ নেই। অপেক্ষার বালু ঘড়ি যেন থেমে গেছে। তারা চুপচাপ বসে আছে, জানে না ঠিক কবে আবার কাজে ডাক পড়বে।
নয়া মিয়ার বাড়ি থেকে ধান কাটার মৌসুম পেরিয়ে গেছে। তার স্ত্রী সকাল থেকে ঘরে বসে, হাতে কাজ নেই। ছেলেমেয়েরা খিদের জ্বালায় চুপ করে থাকে। তাদের চোখে এক ধরনের চাহনি, যা নয়া মিয়ার মনের ওপর যেন ভারী পাথর চাপিয়ে দেয়।
রাত হলে বাড়ি ফিরেও তার সান্ত্বনা মেলে না। ঘর থেকে কান্নার শব্দ আসে, স্ত্রী হয়তো কান্না থামাতে পারে না। ছোট ছেলেটা চুপচাপ শুয়ে থাকে, মুখে কোনো শব্দ নেই, শুধু তার ভেতরের অভাবের কথা বোঝা যায়। "বাবা, খিদে লাগছে,"— এই কথাটা শুনলে নয়া মিয়ার চোখে জল এসে যায়। সে জানে, আজ আর কিছু করতে পারবে না।
দিনের পর দিন কাটে। শহরে কাজ না পেয়ে, গ্রামেও কোনোমতে দিন চলতে থাকে। এই হাটে আসা শ্রমিকদের জীবন যেন এক অস্পষ্ট পথে চলতে থাকে। তারা প্রতিদিন কাজের আশায় আসে, কিন্তু আশাটা আস্তে আস্তে মরে যায়।
শ্রমের হাটের প্রতিটা মানুষ যেন একই জীবনের গল্প বহন করে। তারা চুপচাপ বসে থাকে, কাজ না পেয়ে ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে। নয়া মিয়া ভাবেন, "কবে আবার গ্রামের মাঠে কাজ শুরু হবে? কবে আবার আমার সংসার হাসবে?"
তবে, আশার মরণে যেন তার জীবনের গল্পটা শেষ হয় না। নয়া মিয়া প্রতিদিন এই শ্রমের হাটে আসেন, কোদাল হাতে নিয়ে অপেক্ষা করেন। তার চোখে হয়তো একদিন নতুন দিনের সূর্য উঠবে, নতুন কাজের আহ্বান আসবে।
এই আশা নিয়েই তারা বাঁচে।