প্রকাশিত : ০৭:৪৫
২৭ ডিসেম্বর ২০২১
নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের খুচরা দোকানগুলোয় যে পরিমাণে সিগারেট বিক্রি হয় তার প্রায় ৫ দশমিক ২ শতাংশ সিগারেট কোনো না কোনোভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য সিগারেট প্যাক সম্পর্কিত আইন বিবেচনায় না নিয়ে বিক্রি করা হয়। এছাড়া বাজারে বিক্রীত প্রায় ৪ দশমিক ৮ শতাংশ সিগারেট প্যাকেটের গায়ে থাকা ব্যান্ডরোল নকল বলে এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। নকল ব্যান্ডরোলের কারণে বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
বাংলাদেশে অবৈধ সিগারেটের বিক্রি এবং উৎপাদনের মাত্রা বিষয়ে গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং আর্ক ফাউন্ডেশনের গবেষক এস এম আব্দুল্লাহ। বাংলাদেশের ৮টি জেলার মোট ৮০টি জায়গা থেকে প্রায় ২৪ হাজার সিগারেট প্যাকেট সংগ্রহ করে এই গবেষণা পরিচালনা করা হয়। রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।
অনুষ্ঠানে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ বিষয়ে আরও একটি গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন আর্ক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. রুমানা হক।
প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে এস এম আব্দুল্লাহ বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো দাবি করে, তামাকের ওপর কর বাড়ালে দেশে সিগারেটের অবৈধ বাণিজ্য বেড়ে যাবে। কিন্তু সেটা যে সঠিক নয় তা এখন প্রমাণিত। কারণ প্রতিবছর সিগারেটের দাম বাড়লেও গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে অবৈধ সিগারেটের পরিমাণ খুবই সীমিত। সরকার যদি এ ক্ষেত্রে নজরদারি আরও বাড়ায় এবং তামাক নিয়ন্ত্রণে আরও গতিশীলতা আনতে পারে; তবে এ অবৈধ বাণিজ্যের হার আরও কমে আসবে।
অধ্যাপক রুমানা হক তামাক কোম্পানির অবৈধ হস্তক্ষেপ বিষয়ে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ব্যতীত অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি) আর্টিকেল ৫.৩ বিষয়ে জ্ঞান একেবারেই সীমিত। তিনি আরও বলেন, গবেষণায় অংশ নেয়া অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, তামাক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার থাকা তামাক নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আর্টিকেল ৫.৩-এর অতি দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন এবং একই সঙ্গে বাস্তবায়নকারী সংস্থার সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন।
আর্ক ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় তামাকজনিত ক্ষতি কমানোর লক্ষ্যে গবেষণা পরিচালনার ক্ষেত্রে সক্ষমতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক অংশীজন মতবিনিময় সভায় গবেষণা প্রতিবেদন দুটি উপস্থাপন করা হয়। যুক্তরাজ্যের গ্লোবাল চ্যালেঞ্জস রিসার্চ ফান্ডের টোব্যাকো কন্ট্রোল ক্যাপাসিটি প্রোগ্রামের তত্ত্বাবধানে এ সভার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের পরিচালক (গবেষণা) ড. মো. নুরুল আমিন ও সেন্টার ফর ল অ্যান্ড পলিসি অ্যাফেয়ার্সের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন।
ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘তামাকের বিরুদ্ধে যারা কাজ করছেন, তাদের তুলনায় তামাক কোম্পানিগুলোর রিসোর্স অনেক বেশি। তবুও দেশের স্বার্থে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে এই অসম যুদ্ধ আমাদের লড়ে যেতে হবে। আমি সংসদেও বলেছি যে, তামাক যদি নিয়ন্ত্রণ না করা যায় তবে ৪০ বছরের মধ্যে আমাদের দেশ একটি ১৮ কোটি লোকের হাসপাতালে পরিণত হবে।’
তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার ঘোষণায় দেশে একটি রাজনৈতিক সদিচ্ছার জায়গা তৈরি হয়েছে। যার ফলে কিছুদিন আগে ১৯১ জন জাতীয় সংসদ সদস্য তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার পক্ষে আধা সরকারি পত্র লিখেছেন।
তিনি আরও বলেন, শুধু সরকারের একান্ত প্রচেষ্টায় তামাক নিয়ন্ত্রণ এবং তামাকজনিত ক্ষতি প্রতিকার করা সম্ভব নয়। গবেষক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং উন্নয়ন কর্মীসহ সবার এ প্রচেষ্টায় এগিয় আসতে হবে। তামাক নিয়ন্ত্রণের সপক্ষে যারা কথা বলেন তাদের সরকারকে পথ দেখাতে হবে এবং সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে হবে। তাছাড়া এ প্রচেষ্টায় অগ্রগতির সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তিনি আশা করেন, সরকারও নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করেই তামাক নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে।
ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, তামাক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার থাকা অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি আরও বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত দেশ গড়ে তুলতে কাজ করে যেতে হবে। আমরা আশার আলো তখনই দেখতে পাব যখন দেখব সরকার নীতিনির্ধারণে এই তামাক নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারগুলো আরও গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিয়ে আসবে।
ড. মো. নুরুল আমিন বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা, উচ্চ মাপের গবেষণা এবং গবেষণার ফলভিত্তিক নীতিপ্রণয়ন। ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত দেশ গড়তে ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের গাইডলাইন অনুসারে আরও কঠিনভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করতে হবে; বিশেষ করে দেশের যুবসমাজ, যারা পরবর্তী সময়ে ধূমপায়ী হয়ে উঠতে পারে, তাদের নিয়ে আরও বেশি কাজ করতে হবে। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি, উন্নয়ন কর্মী, ছাত্র-ছাত্রী এবং গবেষকরা অংশ নেন।