প্রকাশিত : ০৪:০৩
২৬ ডিসেম্বর ২০২১
শরীফ শাওন : ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে আগুনের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪০ জনে। এছাড়াও দগ্ধ অবস্থায় ৭২ জনকে বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। বাকিদের বরিশাল, ঝালকাঠিসহ আশপাশের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি করা হয়েছে।
এখনও সন্ধান মেলেনি বরগুনার নারী ও শিশুসহ প্রায় শতাধিক মানুষের। বিভিন্ন এলাকা জুড়ে চলছে শোকের মাতম। বন্ধ রয়েছে অনেকের মুঠোফোন।
বরগুনার বিভিন্ন এলাকার নিখোঁজ যাত্রীদের খুঁজতে ঘটনাস্থলে গেছেন স্বজনরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবিসহ পোস্ট দিয়ে খোঁজার চেষ্টা করছেন তারা। স্বজনরা জানান, নিখোঁজ যাত্রীদের তথ্য দিতে পারছে না বরগুনা নৌবন্দরও।
শুক্রবার ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আরএমও ডা. আমির হোসেন বলেন, দুইশর বেশি যাত্রী আহত হয়েছেন। গুরুতর আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (শেবাচিম) হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. সাইফুল ইসলাম জানান, তাদের মধ্যে ৯০ ভাগ দগ্ধ পাঁচ জনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। হাসপাতালে সার্জারি বিভাগের তিন ওয়ার্ডে ৫০ জন চিকিৎসক ও ইন্টার্ন চিকিৎসক বাকি দগ্ধ রোগীদের সেবা দিচ্ছেন। ৫ ও ১০ ভাগ দগ্ধ হওয়ায় তারা শঙ্কামুক্ত। তবে সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন যাত্রী ও স্বজনরা জানান, লঞ্চের ইঞ্জিন রুম থেকে আগুনের লেলিহান শিখা দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে অনেকে প্রান বাঁচাতে ছুটোছুটি করতে থাকেন। এসময় যাত্রীদের ধাক্কাধাক্কিতে অনেকে পদদলিত হয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হন। আবার আত্মরক্ষার চেষ্টায় স্বজনদের রেখেই নদীতে ঝাঁপ দিয়েছেন অনেকে। অনেকে শরীরে আগুন নিয়েই লাফিয়ে পড়েছেন। ধোঁয়ার কারণে দেখতে না পাওয়ায় কিছু যাত্রী তিনতলা ও দোতলা থেকে নিচতলায় পড়ে আহত হয়েছেন। এখনও অনেকে তার স্বামী, স্ত্রী, সন্তান ও স্বজনদের খুঁজে পাচ্ছেন না।
লঞ্চে আগুনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন তাইফা আফরিন (১০) নামের এক শিশু। তিনি বরগুনার কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নের রোডপাড়া গ্রামের বশির উদ্দিনের মেয়ে। স্বজনরা জানান, তাইফার নানা আলী শিকদার ক্যান্সার আক্রান্ত। ঢাকায় ডাক্তার দেখাতে তাইফা তার বাবা ও নানাসহ লঞ্চযোগে যাত্রা দেন। লঞ্চে আগুণ ধরলে তাইফার নানা জীবন বাঁচাতে নদীদে ঝাপ দেন। তাইফা ও বাবা বশির উদ্দিন অগ্নিদগ্ধ হলে তাইফা মারা যান এবং বাবা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তবে নানা আলী শিকদার এখনও নিখোঁজ রয়েছেন।
অগ্নিকা-ের ঘটনায় লঞ্চ থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রাণে বাঁচেন বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসাইন মোহাম্মদ আল মুজাহিদ। লঞ্চের তৃতীয় তলা থেকে লাফিয়ে দোতলায় নেমে প্রাণে বেঁচে গেছেন তিনি। তবে পা ভেঙে গেছে তার স্ত্রী উম্মুল ওয়ারার।
লঞ্চ মালিক হাম জালাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, লঞ্চের কেরানী আনোয়ার ভোর রাত ৩টার ৫মিনিটে তাকে ফোন করে আগুন লাগার খবর দেন। সে বলেছে দোতলায় একটা বিস্ফোরণ হয়, সঙ্গে সঙ্গে কেবিনে আর লঞ্চের পেছনের বিভিন্ন অংশে আগুন দেখা যায়। তারপর তৃতীয় তলার কেবিন ও নিচতলায় ছড়িয়ে পড়ে আগুন।
এদিকে অভিযোগ উঠেছে, জানা যায়, লঞ্চটিতে ছিলো না অগ্নি নিরোধকের জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি। আর যাত্রীর সংখ্যাও ছিল ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি।
ডিবিসি নিউজের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৩ আগস্ট ভোরে রাজাপুর উপজেলার বড়ইয়া ইউনিয়ন চরপালট গুচ্ছগ্রাম সংলগ্ন ডুবোচরে আটকা পড়েছিলো লঞ্চ অভিযান-১০।
তবে স্বাভাবিক জোয়ারেও নদীতে নামাতে না পারায় ৯ দিন ধরে চরেই আটকে ছিল লঞ্চটি। এরপরে এই লঞ্চটি একটি ট্রিপ দিয়ে বরগুনা থেকে ঢাকা যায়। পরে ঢাকা থেকে বরগুনার উদ্দেশে লঞ্চটি ছেড়ে আসলে পথিমধ্যে ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়লে লঞ্চের যাত্রীদের অন্য লঞ্চের মাধ্যমে বরগুনায় নিয়ে আসা হয়। এরপর দীর্ঘদিন লঞ্চটি নতুন মেশিন স্থাপনের কাজে ছিল। নতুন ইঞ্জিন স্থাপনের পরে গত ১৯ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে প্রথম ট্রিপ বরগুনা আসে।
আগুন লাগা লঞ্চের যাত্রী ফারুক হোসেন জানান, আগুন লাগার ১৫ মিনিট পর লঞ্চ ভিড়ছিল তখনও মাসুষের গায়ে আগুন লাগে নাই। সবাই দৌড়াদৌড়ি আর কান্নাকাটি করছিলো। কিন্ত চরে নোঙর করার মত কেউ ছিলো না। জোয়ারের তোড়ে লঞ্চ ভেসে মাঝ নদীতে চরে যায়।
জানা গেছে, অভিযান-১০ ঢাকা থেকে বরগুনা যাচ্ছিল। লঞ্চটির যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ৭০০ হলেও ধারণা করা হচ্ছে বৃহস্পতিবার এতে প্রায় হাজারখানেক যাত্রী ছিলেন। ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে থাকা অবস্থায় লঞ্চটিতে আগুন লাগে। পরে পার্শ্ববর্তী দিয়াকুল এলাকায় ভেড়ানো হয়।
বাংলাট্রিবিউন জানায়, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) থেকে জানানো হয়েছে, ৩১০ যাত্রী নিয়ে ঢাকা থেকে বরগুনা যাচ্ছিল লঞ্চটি। যাত্রীরা বলছেন, প্রায় এক হাজারের মতো যাত্রী ছিল লঞ্চে। এদিকে লঞ্চটি ৯০০ যাত্রী বহনে সক্ষম।
ঐ প্রতিবেদন আরও বলা হয়, নৌপথে দক্ষিণাঞ্চলের ঢাকা-বরগুনা রুটের যাত্রী পরিবহনে বছর দুয়েক আগে চালু হয় বিলাসবহুল এমভি অভিযান-১০ লঞ্চ। বরিশালসহ, বরগুনার, বেতাগী কাঁকচিড়া ঘাটে যাত্রী বহন করতো নৌযানটি। মাত্র ১৫ দিন আগে মেরামতের কাজ হয় এটির। এরপর চারটি ট্রিপ সম্পন্ন করে।
বরগুনা পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক মো. হাসানুর রহমান ঝন্টু বলেন, লঞ্চটি এর আগেও একবার চরে উঠিয়ে দিয়েছিল। আমার মনে হয়, লঞ্চ কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে এতগুলো প্রাণ একসঙ্গে গেলো।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. লোকমান হোসেন মিয়া আহতদের খোঁজখবর নিয়ে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে চিকিৎসকদের দায়িত্ব পালন করতে বলেন। এসময় তিনি হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছেন।
বরিশাল ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক কামাল হোসেন ভূঁইয়া এক ব্রিফিংয়ে জানান, আমাদের পাঁচটি ইউনিট উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে। পুরো লঞ্চটি পুড়ে গেছে। লঞ্চটির ইঞ্জিন কক্ষ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
ঝালকাঠির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মঈনুল হক জানান, ভোর ৫টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। যাত্রীদের উদ্ধারে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কাজ করছেন।
জেলা প্রশাসক জহর আলী জানান, রাত ৩টার দিকে লঞ্চের ইঞ্জিন রুমে হঠাৎ আগুন লেগে যায়। সে আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো লঞ্চে। এ সময় যাত্রীরা দগ্ধ হন। প্রাণে বাঁচতে বেশ কয়েকজন নদীতে ঝাঁপ দেন। বরিশাল, পিরোজপুর, বরগুনা ও ঝালকাঠির কোস্ট গার্ড ও ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার অভিযান চলমান রয়েছে।
নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে একজন যুগ্মসচিবকে প্রধান করে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী সাত দিনের মধ্যে কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব তোফায়েল আহমেদকে আহ্বায়ক এবং উপসচিব আমিনুর রহমানকে সদস্যসচিব করা হয়েছে। এই কমিটিতে বিআইডব্লিউটিএ, নৌপরিবহন অধদপ্তর, নৌপুলিশ, জেলা প্রশাসন এবং ফায়ার সার্ভিসের একজন করে প্রতিনিধিকে রাখা হয়েছে।
নৌপ্রতিমন্ত্রী বলেন, লঞ্চে অগ্নিকা-ে কোনো রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আছে কি না, তা এখনই বলতে পারছি না। আগুনে পুরো একটি লঞ্চ পুড়ে যাওয়ার পেছনে কোনো রহস্য থাকতে পারে। নয় তো এভাবে দ্বিতীয় ঘটনা আর বাংলাদেশে ঘটেনি। বিকেলে ৩টার দিকে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে অগ্নিকা-ে ক্ষতিগ্রস্ত লঞ্চ পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।
ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে লঞ্চে অগ্নিকা-ে মৃতদের পরিবার প্রতি দেড় লাখ টাকা দেওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, একই সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে আহতদের চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করা হবে। আমাদের হিসাবমতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে পুড়ে যাওয়া লঞ্চে ৩৫০ জনের মতো যাত্রী ছিল। এর বেশি থাকলে তদন্ত করে দেখা হবে। এছাড়া লঞ্চের ফিটনেস ঠিক ছিল বলে জানতে পেরেছি।
বরগুনার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান জানান, লঞ্চে থাকা বৃদ্ধ এবং শিশুরাই বেশি হতাহত হয়েছেন। এছাড়া লঞ্চে অনেক নারী ছিলেন যারা নদীতে লাফিয়ে পড়েছেন।
বরগুনা জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, লঞ্চে অগ্নিকা-ে হতাহতদের অধিকাংশের বাড়ি বরগুনায়। প্রাথমিকভাবে নিহত প্রত্যেক পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা ও আহতদের ১৫ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হবে।
এক শোকবার্তায় নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা এবং আহতদের আশু আরোগ্য কামনা করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শোকবার্তায় নিহতদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান তারা। আহতদের দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে এবং নিহতদের স্বজনদের নিকট লাশ হস্তান্তরের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।